হঠাৎ করেই সমগ্র দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার প্রধান শিরোনামে উঠে এসেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তাকে নিয়ে বিভিন্ন মহলেই চলছে নানা তর্ক-বির্তক। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে বেশ সক্রীয় রয়েছেন। তবে তিনি ছাত্র জীবনে বিএনপি দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রদলেও বিশেষ পদে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামীলীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগে যোগ দেন। এবং পরবর্তীতে যুবদলে যোগদেন। এবং ধাপে ধাপে আওয়ামীলীগ দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে উঠে আসেন। তার এই ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগের পদ নিয়েও বেশ বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। এরই সুত্র ধরে এই বিষয়ে বিস্তারিত উঠে এসেছে প্রকাশ্যে।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান একসময় বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক। ১৯৯৫ সালে মমেক শাখা ছাত্রদলের যে কমিটিতে মুরাদ হাসান পদে ছিলেন সেই কমিটির একটি কপি হাতে এসে পৌছেছে। ক্ষমতার পালাবদল হলে মুরাদ হাসান ভোল পাল্টে ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রাজনীতিতে বাঁক বদলের সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন ছাত্রদল নেতা মুরাদ। ১৯৯৮ সালে তিনি ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক পদে থেকেই সরাসরি ছাত্রলীগে যোগ দেন। রাতারাতি সাচ্চা ছাত্রলীগার হিসেবে নিজেকে জাহির করেন মুরাদ। ছাত্রলীগে গিয়েও তিনি দাপট দেখিয়ে কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। এর দুই বছর পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পদ পেয়ে যান মুরাদ। মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পান ১৯৯৩ সালে। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় ছত্রছায়ায় থাকতে ও রাজনৈতিক সুবিধা নিতে তখন ছাত্রদলের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা।
বিএনপি শীর্ষ এক নেতার পরিবারকে নিয়ে আ/প/ত্তিকর বক্তব্যের পর ঢাকাই সিনেমার এক নায়িকার সঙ্গে মুরাদ হাসানের একটি ফোনালাপের অডিও ভাইরাল হয়ে যায়। যেখানে ওই নায়িকাকে ধর্ষণের হুমকি দিতে শোনা যায় মুরাদকে। পরিপ্রেক্ষিতের দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুরাদ হাসানকে মঙ্গলবারের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। সেদিনই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, মুরাদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জঘন্য, নিকৃষ্ট কথাবার্তা বলছেন। কাকে নিয়ে করছে? একজন ভুঁইফোড় ডাক্তার ছিলো শুনেছি, সম্ভবত জামালপুরের সরিষাবাড়ীর। এটাও শুনেছি সে নাকি একসময় ছাত্রদল করতো। দুঃখের কথা, দুর্ভাগ্যের কথা। আগে সে ছাত্রদল করতো। সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রচার সম্পাদক ছিলো। পরবর্তীকালে সে ছাত্র লীগে জয়েন করেছে। ধিক্কার দেই আমি তাকে। সেইম।’
ফখরুলের বক্তব্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে। মুরাদ বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে যুক্ত হয়েছিলেন বলে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সেই কমিটির একটি কপিও হাতে এসেছে। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের ৭১ সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাতে সভাপতি ছিলেন মাহবুব-উল কাদির ও মো. ইসাহাক। ডা. ইসাহাক গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের কমিটিতে প্রচার সম্পাদক ছিলেন মুরাদ। তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে এম-৩০ ব্যাচে মুরাদ হাসান এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। পরে মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছাত্রদলের কমিটির নেতারা সবাই ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যান। কিন্তু মুরাদ হাসান ক্যাম্পাসেই থেকে যান এবং ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ছাত্রলীগে যোগ দেন।
তিনি আরও বলেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান তার পিতার ক্ষমতার জোরে ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে পদ বাগিয়েছেন। মুরাদ ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার পালাবদল হয়। অর্থাৎ বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুই আমলেই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী। ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও তৎকালীন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার এ বিষয়ে বলেন, মুরাদ হাসান ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রদল থেকে পদত্যাগ করার সময় মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। ওই সময়ে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম রিপনও গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ বিষয়ে মুরাদ হাসানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মুরাদ হাসান ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ২০০১ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এসবিবিএস পাস করেন। ২০১১ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে এম ফিল ডিগ্রি নেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া জীবনীতে দাবি করা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে জন্ম নেওয়া মুরাদ ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার ‘কার্যকরী সদস্য’ ১৯৯৭ সালে ‘সাংগঠনিক সম্পাদক’ এবং ২০০০ সালে ‘সভাপতি’ নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ‘কার্যকরী সদস্য’ নির্বাচিত হন মুরাদ। পাশাপাশি জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের ‘কার্যকরী সদস্য’, সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের ‘কার্যকরী সদস্য’, জামালপুর জেলা কমিটির ‘স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক’র দায়িত্বও তিনি পালন করেন। জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান তালুকদারের ছেলে মুরাদ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী, মেস্টা ও তিতপল্যা) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুরাদ। ২০১৯ সালে তাকে স্বাস্থ্য থেকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিএনপি দলের চেয়ার পারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাতিনি জাইমা রহমানকে নিয়ে অশোভন কথা বলায় বিএনপি দলের নেতাকর্মীরা তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এবং তার পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। এছাড়াও ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ডা. মুরাদ হাসানের কুশপত্তলিকা দাহ করেছে। এদিকে মুরাদ হাসান সম্পর্কে বিনএনপি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন আমদের দূর্ভাগ্যে মুরাদ হাসান এক সময় ছাত্রদলের পদে ছিলেন।