নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে দেশের ১১৩তম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কুষ্টিয়া হাউজিং এস্টেটের ৬ ও ৭ নম্বর প্লটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাস্তবে সেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ছিল না। সে সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে হানিফ তার স্ত্রী ফৌজিয়া আলমের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন।
ট্রাস্টি বোর্ডে হানিফ নিজেও সদস্য ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দেন “লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়”। অনুমোদন মিললেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করতে পারেননি। প্রকল্পের কাজ চলমান অবস্থায় রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের সময় হানিফ ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন। একাধিক দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, বর্তমানে তিনি কলকাতার একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন।
ভারত থেকে থেকেই হানিফ নানা অনিয়মে অনুমোদন পাওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সক্রিয় করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে চলতি বছর থেকেই শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমতি নেন। ইতোমধ্যে জাঁকজমকভাবে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাঁচটি বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ মার্কেটের সপ্তম ও অষ্টম তলায় সাজানো হয়েছে আধুনিক “লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়”। গণঅভ্যুত্থানের পর এক বছরেরও কম সময়ে এসব সম্পন্ন করেছেন পলাতক নেতা হানিফ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ইউজিসি ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে। নভেম্বরেই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। এখন পর্যন্ত ২৪ জন শিক্ষক ও ৩৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে পাঁচটি বিভাগে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিটি বিভাগে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি থাকলেও ৩১ জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বিভাগে মোট ১০১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম একসময় বন্ধ হয়ে যায়। তবে ভারত থেকে থেকেই হানিফ নানা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু করেন। ২০২৪ সালের নভেম্বরে তিনি তার স্ত্রীকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দিয়ে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও পূর্বের ভাইস চেয়ারম্যান হালিমুজ্জামানকে চেয়ারম্যান করেন। ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সময় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ফৌজিয়া আলম, সদস্য ছিলেন হানিফ, আর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন হেলথকেয়ার ফার্মার সিইও হালিমুজ্জামান।
ট্রাস্টি বোর্ডে আরও ছিলেন আর্কিটেক্ট তারিক হাসান (সেক্রেটারি), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান (কোষাধ্যক্ষ), ইবির আইন বিভাগের অধ্যাপক সেলিম তোহা এবং গার্মেন্টস মালিক আব্দুল মান্নান। হানিফ ও তার স্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতে পালালেও বাকিরা ট্রাস্টি বোর্ডে বহাল রয়েছেন। কৌশলে কেবল কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকে বাদ দিয়ে পুরো বোর্ড নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন হানিফ।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিএনপিপন্থি একজন শিক্ষককে উপাচার্য করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি প্যানেল ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকার প্রথমেই রয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও জিয়া পরিষদের সভাপতি ফারুকুজ্জামান। অন্য দুইজন হলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আক্তারুজ্জামান ও শরিফুল ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে কুষ্টিয়া হাউজিং এস্টেটের ৬ ও ৭ নম্বর প্লটে হানিফের ভাই ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতারের নির্মাণাধীন বাড়ির ঠিকানায় অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার সম্পদের বিরুদ্ধে মামলা করলে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড গোপনে সরিয়ে ফেলা হয়।
এরপর ক্ষমতার দাপটে কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের নির্মাণাধীন নয়তলা ভবনের নকশা পরিবর্তন করে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন হানিফ। তবে মূল নকশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুমোদন ছিল না। বর্তমান জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ বলছে, নকশা উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তৎকালীন চেয়ারম্যান ও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম মাসে তিন লাখ টাকায় ভবনের সপ্তম ও অষ্টম তলা হানিফকে ভাড়া দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান হালিমুজ্জামান জানিয়েছেন, বর্তমানে হানিফ বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর পদধারী যারা ছিলেন, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। হানিফ ও তার স্ত্রী ট্রাস্টি বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছেন। পরে বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকেই চেয়ারম্যান করা হয় এবং নতুন সদস্য যুক্ত করা হয়।



