জাপা নিষিদ্ধের পক্ষে জামায়াত ও এনসিপি, যে কারণে আপত্তি বিএনপির

চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত রোববার তার বাসভবন যমুনায় পৃথক বৈঠক করেছে। বৈঠকগুলোতে জুলাই সনদ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন, নুরুল হক নুরের ওপর হামলা এবং জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নিষিদ্ধ করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।

জামায়াত ও এনসিপি জাপাকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেয়, তবে বিএনপি জানায় তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। প্রধান উপদেষ্টা তিন দলকেই স্পষ্ট করে বলেন, পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, “কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবে, তা জাতির জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক হবে।”

বৈঠক শেষে বিএনপি নির্বাচনে আস্থা প্রকাশ করে, কিন্তু জামায়াত জানায় তারা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে শঙ্কিত। জামায়াতের মতে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত হবে।

জামায়াতের মতো এনসিপিও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করে। তারা গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলে এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে।

এ বৈঠকগুলো হয় সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার প্রেক্ষাপটে। গত শুক্রবার রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পুলিশ ও সেনাসদস্যদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। সরকার ঘটনাটির নিন্দা জানিয়েছে এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে।

এই ঘটনার পরপরই প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে জামায়াত, পরে এনসিপি এবং সবশেষে বিএনপিকে আলোচনায় ডাকেন।

বিএনপির আশ্বাস

বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে, বিলম্বের সুযোগ নেই।”

জামায়াতের অভিযোগ ছিল, লন্ডন বৈঠক থেকে নির্বাচন তারিখ ঘোষণা করে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির প্রতি দুর্বলতা দেখিয়েছেন। এর জবাবে ফখরুল বলেন, এ দাবি “একেবারেই ভিত্তিহীন।” তিনি বলেন, “দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা কথা বলতেই পারেন। তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর আলাপ জাতিকে আশ্বস্ত করেছে।”

নুরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, বিএনপি প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছে এটি “অত্যন্ত গর্হিত ও উদ্বেগজনক কাজ” এবং এর সঠিক তদন্ত জরুরি। তিনি দাবি করেন, কিছু মহল নির্বাচনে বিলম্ব ঘটাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

ফখরুল জানান, বৈঠকে জাপার বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তবে বিএনপির একজন নেতা সমকাল-কে বলেন, তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয় এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

বিএনপি নেতারা আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা দলগুলোকে মতভিন্নতা কমিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

জামায়াতের শঙ্কা

জামায়াতের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি নুরের ওপর হামলার তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি দাবি করেন।

ড. তাহের জানান, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতির পক্ষে। একটি দলের চাপে যদি প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়, তবে অংশগ্রহণ সংকুচিত হবে এবং “নির্বাচনের ট্রেন যাত্রী ছাড়া চলতে শুরু করবে।”

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তাহের বলেন, “একটা দল আগে চাঁদাবাজি করত, এখন আরেকটা করছে। সরকার কোথাও ব্যবস্থা নেয় না। যে সরকার একটা বাসস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজ মুক্ত করতে পারে না, তারা নির্বাচনে সন্ত্রাসীদের ঠেকাবে কীভাবে?”

জামায়াত জুলাই সনদের বাস্তবায়ন এবং এর অধীনে নির্বাচন দাবি করে। তারা প্রস্তাব করে, প্রয়োজনে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। তাহের বলেন, “জনগণ যদি জুলাই সনদ ও PR না চায়, জামায়াত মেনে নেবে।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, জুলাই সনদ চূড়ান্তের আগে নির্বাচন তারিখ ঘোষণা সঠিক হয়নি। জামায়াতই প্রথম ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দাবি করেছিল, কিন্তু লন্ডন বৈঠক ও একতরফা ঘোষণার কারণে তারা স্বীকৃতি পায়নি।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন যে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সব ব্যবস্থা নেবে।

জাপা নিষিদ্ধের দাবির বিষয়ে তাহের বলেন, “তারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিল। তাদের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।”

জামায়াতের প্রতিনিধি দলে ছিলেন মিয়া গোলাম পরওয়ার ও রফিকুল ইসলাম খান।

এনসিপির দাবি

বৈঠক শেষে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব সাংবাদিকদের বলেন, তার দল জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতি ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তিনি বলেন, গণপরিষদে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র দূর করতে হবে।

তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে মনে করিয়ে দেন, এনসিপি শুরু থেকেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

আদীব আরও বলেন, গুম কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব রাষ্ট্রীয় সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাপাকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আদীব বলেন, তারা আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে অবৈধ নির্বাচন বৈধতা দিয়েছে।

নুরের ওপর হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, মিডিয়া ও রাষ্ট্রের কিছু সংস্থা পুরনো কাঠামো রক্ষা করতে মরিয়া।”

এনসিপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন হাসনাত আবদুল্লাহ, হান্নান মাসউদ ও তাসনিম জারা।

ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা

বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যে সময় নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন, সেই সময়েই ভোট হবে।

প্রধান উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবে, তা জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”

ড. ইউনূস জোর দিয়ে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন আয়োজন করা। শফিকুল আলম আরও বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা বারবার উল্লেখ করেছেন, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা নির্বাচন।”

বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ নিয়ে নিজেদের মতামত জানায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আলী রীয়াজ এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনির হায়দার জুলাই সনদ চূড়ান্তকরণের অগ্রগতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন।

Scroll to Top