রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকোর গ্রামে মিনারুল, তার স্ত্রী মনিরা, দেড় বছরের মেয়ে মিথিলা এবং স্কুলপড়ুয়া ছেলে মাহিমের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মিনারুলকে ফ্যানের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। একই ঘরের বিছানায় ছিল ছেলের মরদেহ। অন্য ঘরে পাওয়া যায় স্ত্রী ও মেয়ের মরদেহ। মৃত্যুর আগে মিনারুল একটি চিরকুট লিখে গেছেন যেখানে তিনি লিখেছেন—“আমি যদি এই চিরকুট না লিখে যাই, তবে বাংলার পুলিশ কাউকে না কাউকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে।”
শুক্রবার দুপুরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। সিআইডি ও পিবিআই আলামত সংগ্রহ করেছে। পুলিশের ধারণা, বিপুল ঋণের চাপ সামলাতে না পেরে মিনারুল প্রথমে স্ত্রী ও সন্তানদের শ্বাসরোধে হত্যা করে পরে আত্মহত্যা করেছেন।
পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার রাতে মিনারুল স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও গলায় ফাঁস দেন। ঘটনাস্থলে দেখা যায়, এক ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে মনিরা ও ছোট্ট মিথিলা, পাশের ঘরে বিছানায় মাহিমের মরদেহ, আর সেই ঘরেই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছিল মিনারুল। ওই ঘর থেকে দুটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়, যা মিনারুলের লেখা বলে স্বজনরা নিশ্চিত করেছেন।
“আমি মিনারুল, নিচের সব কথা আমার নিজের লেখা। লিখছি এই কারণে যে আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাব। এই মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ যদি না লিখি তবে বাংলার পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে। আমি মিনারুল প্রথমে আমার স্ত্রীকে মেরেছি, এরপর আমার ছেলে মাহিমকে, তারপর মেয়ে মিথিলাকে। সবশেষে আমি গলায় ফাঁস দিয়েছি।”
“আমি নিজ হাতে সবাইকে মেরেছি। কারণ আমি একা যদি মরে যাই, তবে আমার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরলাম ঋণ আর অভাবের কারণে। এই কষ্ট আর সহ্য হচ্ছিল না। তাই বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো মনে হয়েছে।”
স্বজনরা জানিয়েছেন, সেদিন রাতে মনিরা ও মেয়ে এক ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মাহিম ঘুমিয়েছিল পাশের ঘরে। রাত ১১টার দিকে মিনারুল বাড়ি ফেরেন। এরই মধ্যে তার বড় ভাই রুহুল, স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে অন্য ঘরে ঘুমিয়ে যান। উঠোনে ঘুমাচ্ছিলেন বাবা রুস্তম আলী ও মা আনজুরা বেগম। রাতে কী ঘটেছে, কেউ টের পাননি। সকালে প্রায় ৮টার দিকে আনজুরা ছেলেকে বারবার ডাকলেও সাড়া পাননি। রুস্তম আলী ঘরের টিনের ওপর উঠে ভেতরে তাকাতেই দেখেন মিনারুল ঝুলছে। পরে দরজা ভেঙে ঢুকে একে একে সবার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মিনারুলের চাচি জানেহার বেগম বলেন, “মিনারুলের কিস্তির টাকা ছিল। কিস্তির জন্য সে ঘরে থাকত না। মাঝেমাঝেই লোকজন এসে টাকা চাইত। আমরা বলতাম, বাড়িতে নাই। সে কখনো কৃষিকাজ, কখনো ট্রাকের হেলপার, আবার কখনো জাল টানার কাজ করত। ওর রাগ ছিল বেশি। কেউ খারাপ কিছু বললে কাজ ছেড়ে দিত। অভাব লেগেই থাকত।”
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মুর্শেদ বলেন, “দুই দিন আগে মিনারুল আমার কাছে এসে বলেছিল, ঘরে চাল নাই। আমি তাকে চাল কেনার জন্য দুই হাজার টাকা দিয়েছিলাম।” তিনি আরও জানান, “মিনারুল অনেক দিন ধরেই ঋণের চাপে ছিলেন। তিন বছর আগে তার বাবার জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকার ঋণ শোধ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আবার কিস্তি নিয়েছিল। শোনা যায়, সে জুয়া খেলত। এর কারণেও দেনায় জড়িয়ে পড়েছিল।”
শুক্রবার সকালে স্বজনেরা বাড়ির উঠোনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিনারুলের মা বলছিলেন, “ও জান, ক্যান গেলি রে বাবা। আমি তো জমি বেচে আবার দিতাম রে জান। আমার কিছুই রইল না।”
রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে স্ত্রী ও মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। ছেলেকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছি। আর মিনারুল আত্মহত্যা করেছেন। তবে ময়নাতদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “লাশগুলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর সঠিক কারণ জানা যাবে। জুয়ার বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আত্মীয়রা জানিয়েছে, চিরকুটগুলো মিনারুলের লেখা। সেখানে আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ আছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।”

