জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশজুড়ে অস্থিরতা ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত চলছে বলে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই চক্রান্তে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে।
গোয়েন্দা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পলাতক আওয়ামী লীগপন্থী ‘গডফাদার’ নেতারা তাদের অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছেন—দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক না থাকে এবং যে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটলে তা কাজে লাগাতে হবে। এই নির্দেশনার পর থেকেই দলীয় কর্মীরা মাঠে নেমে বড় ধরনের নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং প্রকৃত ও ভুয়া আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে মরিয়া।
সূত্র আরও জানায়, সম্প্রতি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আওয়ামী লীগ বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনমনে ক্ষোভ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে মঙ্গলবার শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সচিবালয়ের ভেতরে ও বাইরে সংঘর্ষে প্রায় ৮০ জন আহত হন, বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর হয়। অভিযোগ উঠেছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এই বিক্ষোভে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার স্লোগান দেন।
এর আগে, “টুঙ্গিপাড়ায় কবর ভাঙা হবে” এমন গুজব ছড়িয়ে গোপালগঞ্জে সহিংসতা ঘটানো হয়। বর্তমানে গণ-অভ্যুত্থানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তাও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগ।
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দলীয় অনুসারীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়া, জনমনে ক্ষোভ উসকে দেওয়া এবং ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক মাধ্যমে স্পর্শকাতর বিষয়ে গুজব ও অপপ্রচার চালাতে নির্দেশ দিয়েছে।
বুধবার রাতে যুগান্তরকে দেওয়া বক্তব্যে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, “নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আমাদের সাঁড়াশি অভিযান চলছে। মাইলস্টোন ও সচিবালয়ের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার পক্ষে স্লোগান দেওয়া শাকিল মিয়া শাক্কুকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “অপরাধীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্যরা বিভিন্ন আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা তাদের গ্রেফতার করছি এবং অভিযান অব্যাহত আছে।” তিনি নিশ্চিত করেন, দিয়াবাড়ি ও সচিবালয়ের ঘটনার পেছনে বিরোধী পক্ষের ইন্ধন রয়েছে।
সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের পর মঙ্গলবার ড. আসিফ নজরুল, সিআর আবরার, শফিকুল আলমসহ সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষোভকারীরা তাদের প্রায় ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষা সচিবকে সরিয়ে দেয় এবং বাকি দাবিগুলোর বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের আশ্বাস দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, আন্দোলনটি মূলত পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তারা “লাশ গুম” হওয়ার গুজব ছড়িয়েছে। দুর্ঘটনায় আটকে পড়া শিক্ষক পূর্ণিমা দাস ফেসবুকে আহ্বান জানিয়েছেন—ভুল তথ্য না ছড়াতে এবং মানুষের আবেগ নিয়ে খেলা না করতে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান হতে পারে। এ নিয়ে ড. ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করেছেন। জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানও জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, “আমরা যারা দীর্ঘদিন শেখ হাসিনার পতনের জন্য আন্দোলন করেছি, তাদের মধ্যে এখন বিভক্তি। এর সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।” তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যেকোনো মূল্যে নির্বাচন বানচাল করতে চায়।”
গণঅধিকার মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মহাসচিব সাইফুল হক বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ গোপন তৎপরতা ও অপপ্রচারে লিপ্ত। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করলে এই সংকট নিরসন হবে।”
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে গুলিস্তান থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুই সদস্য মেহেদী হাসান ফাহিম ও আরিফুর রহমান রাজাকে অবিস্ফোরিত ককটেলসহ গ্রেফতার করা হয়। তারা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, সিনিয়র নেতাদের নির্দেশে আতঙ্ক ছড়াতে তারা এসব ককটেল স্থাপন করছিল। সন্ধ্যায় সচিবালয়ের সামনে একাধিক ছাত্রলীগ কর্মী “শেখ হাসিনা আসবে” স্লোগান দিলে চারজনকে আটক করা হলেও মূল স্লোগানদাতারা পালিয়ে যায়।
উত্তরা বিভাগের ডিসি মহিদুল ইসলাম বলেন, “উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ করার পেছনে রাজনৈতিক উসকানি ছিল। তবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ধৈর্যের সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করেছি। এখন আমরা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছি এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।”
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আব্দুর রহিম মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, “দিয়াবাড়িতে উপদেষ্টাদের অবরুদ্ধ করার সময় ফ্যাসিবাদী চক্রের সদস্যদের উপস্থিতি ছিল। আমরা সেখান থেকে রিয়াজ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছি যার বিরুদ্ধে আগেও ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলা আছে।”
সূত্র জানায়, শুধু দিয়াবাড়ি বা সচিবালয় নয়—দেশজুড়ে নাশকতার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে পরাজিত আওয়ামী লীগ। ২০ জুলাই শ্যামপুরে বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টা চালানোর সময় সিয়াম সরকার নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, সহযোগী রাফসানের সঙ্গে বাসে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়েছিলেন। ১৮ জুলাই মিরপুর থেকে চারজন ছাত্রলীগ কর্মী বিস্ফোরক ও দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়। তারা জানিয়েছে, ছাত্রদলের মিছিলে নাশকতার পরিকল্পনায় এসব সংগ্রহ করেছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে দিল্লিতে পালিয়ে যান। তার সঙ্গে পালান দলের শীর্ষ নেতা, সংসদ সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। কেউ কেউ দেশে আত্মগোপনে থাকলেও বিভিন্ন মাধ্যমে এখনো সক্রিয়। শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে নিয়মিত অডিও বার্তা পাঠাচ্ছেন, হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। তার নির্দেশে নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে এখন পর্যন্ত তারা সফল হতে পারেনি।
নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠন নতুন কৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার লোভে প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিই এখন তাদের মূল হাতিয়ার।



