জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় সংঘটিত নৃশংস দমন, গুম এবং হত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবশেষে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
টেলিভিশনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সেই নাম—শেখ হাসিনা। এজলাস কক্ষে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, সময় যেন থেমে যায়।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম চলছিল। এখন এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে – গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
কিন্তু এই মুহূর্তে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নেই। তিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন।
এখন প্রশ্ন হল – ভারত কি বাংলাদেশের অনুরোধে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে?
২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে, যদি কোনও ব্যক্তি এক দেশ থেকে অপরাধ করে অন্য দেশে পালিয়ে যায়, তবে তাকে নির্দিষ্ট শর্তে ফেরত পাঠানো সম্ভব। চুক্তির ৬ নম্বর ধারা অনুসারে, এক বছরেরও বেশি সাজাপ্রাপ্ত বা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই, ভারত আইনত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য।
কিন্তু এখানেই জটিলতা তৈরি হয়।
চুক্তির ৯ নম্বর ধারা অনুসারে, যদি অপরাধ “রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” হয় অথবা অভিযুক্ত রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে, তাহলে প্রত্যর্পণ বাধ্যতামূলক নয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলি ইঙ্গিত দেয় যে শেখ হাসিনার বর্তমান অবস্থা ভারতীয় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আওতার মধ্যে পড়ে।
ঢাকায় ছাত্র এবং সাধারণ জনগণের সহিংস বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকার কূটনৈতিক মহলে দাবি করা হচ্ছে যে তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দিল্লিতে প্রবেশ করেছিলেন।
এই বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি। তবে নিরপেক্ষ সূত্রগুলি বলছে যে দিল্লি এখনও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে এবং সময় নিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন যে শেখ হাসিনা মোদী প্রশাসনের দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত মিত্র’। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক ভারসাম্য, চীন-বিরোধী কৌশল – সকল ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা ভারতের পাশে ছিলেন।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে – ভারত কি তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রকে ফিরিয়ে দেবে? নাকি বিষয়টি রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মধ্যেই ঝুলে থাকবে?
ভারতীয় আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কিছু আইনি ‘ছাড়পত্র’ আছে, যার ভিত্তিতে তারা চাইলেই দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি অনির্দিষ্টকালও অপেক্ষার তালিকায় রাখতে পারে শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ।
ঢাকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্য বলেছে যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে বাস্তবতা হলো ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এই প্রক্রিয়া কার্যকর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।
এদিকে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন আলোচনা চলছে – শেখ হাসিনা তৃতীয় কোনও দেশে চলে যেতে পারেন। যুক্তরাজ্য, কানাডা বা সংযুক্ত আরব আমিরাত তার সম্ভাব্য গন্তব্য হতে পারে। যদি এটি ঘটে, তাহলে ভারতও সরাসরি প্রত্যর্পণের দায় এড়াতে সক্ষম হবে।
এখন প্রশ্ন হল – বাংলাদেশ কি ভারতকে বিশ্বাস করতে পারবে?
আর ভারত – তারা কি বন্ধুত্বের স্মৃতি ধরে রাখবে, নাকি আইনি ও নৈতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতা মেনে চলবে?