শেখ মুজিবসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল

“মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ৪০০-র বেশি এমএনএ/এমপিএ-র মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) কর্তৃক জারি করা নতুন এক অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এখন থেকে এসব নেতাকে “মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা” হিসেবে পরিচিত করা হবে।

আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে মঙ্গলবার রাতে এই অধ্যাদেশটি জারি করা হয়।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারই নন, আরও চার শ্রেণির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

১। প্রবাসী বাংলাদেশি পেশাজীবী যারা মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

২। মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যেসব ব্যক্তি কর্মকর্তা, কর্মচারী বা সহকারী (কূটনীতিকসহ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৩। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সকল শিল্পী ও কর্মচারী এবং দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি সাংবাদিক যারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন।

৪। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা।

২০২২ সালের বাতিল হওয়া জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন অনুযায়ী, মুজিবনগর সরকারের এমএনএ ও এমপিএসহ উপরোক্ত চার শ্রেণির লোকজনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এই স্বীকৃতি বাতিল করে তাদের “মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

যুদ্ধকালীন সময়ের রাজনীতিকদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা বাতিল করাকে কেন্দ্র করে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ১৫ মে, উপদেষ্টা পরিষদ আইন মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনার শর্তে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করে। এরপর মন্ত্রণালয় “সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস অনুমোদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে অধ্যাদেশটি জারি হয়।

অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জামুকার খসড়া সংজ্ঞার তুলনায় “মুক্তিযোদ্ধা” ও “মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা” সংজ্ঞায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে খসড়া অনুমোদিত হওয়ার পরও সেটি দ্বিতীয়বার সংশোধিত হয়। এই অধ্যাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় উভয়কেই পুনঃসংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

অধ্যাদেশে “মুক্তিযোদ্ধা”-এর নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী:

“মুক্তিযোদ্ধা” বলতে সেই সব ব্যক্তিকে বোঝাবে, যারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন অথবা ভারতে গিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী—রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিজাম-ই-ইসলাম এবং পিস কমিটির—বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে যারা সরকারের নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সসীমা অনুযায়ী নাগরিক ছিলেন, সেই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী, তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনী, বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর) অধীন যেকোনো স্বীকৃত বাহিনী যেমন নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্যদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এছাড়া:

(ক) পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা নির্যাতিত সকল নারী (বীরাঙ্গনা), এবং
(খ) ফিল্ড হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদানকারী সকল চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসা সহকারীদেরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে।

অধ্যাদেশে “মুক্তিযুদ্ধ”-এর হালনাগাদ সংজ্ঞা অনুযায়ী:

“‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণের দ্বারা পরিচালিত সেই যুদ্ধকে বোঝাবে, যা একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের—রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নিজাম-ই-ইসলাম এবং পিস কমিটি—বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল।”

Scroll to Top