দাড়ি রাখা এবং নামাজ পড়াই ছিলো বিমান সৈনিকদের অপরাধ

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গোপন ‘আয়না ঘর’ সম্পর্কে এখনও বেশিরভাগ মানুষ অবগত নন। অথচ এখানেই, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং একটি ইসলামি দাওয়াতি প্রতিষ্ঠানে দান করার মতো নিরীহ কাজের অভিযোগে ১০ জন সৈনিককে বন্দি রেখে চলেছিল পৈশাচিক নির্যাতন।

ঘটনাটি শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের অক্টোবরে। একে একে বিমান বাহিনীর ১০ জন তরুণ দেশপ্রেমিক সৈনিক নিখোঁজ হয়ে যান। তাদের অনেকেই নামাজ পড়তেন, দাড়ি রাখতেন এবং হাফপ্যান্ট পরতে আপত্তি করতেন। এবং সেই “ধর্মীয় অনুশীলন” তাদের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গিবাদের’ সন্দেহে পরিণত হয়েছিল। অভিযোগ ছিল—তারা ইসলামি স্কলার মুফতি জুবায়ের আহমেদের একটি দাওয়াতি প্রতিষ্ঠানে কিছু টাকা দান করেছেন।

বিমান বাহিনীর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিট, ‘ফিল ইউনিট’, গোপনে তাদের একে একে তুলে নিয়ে যায়। কিছু তাদের অফিস থেকে, কিছু তাদের কক্ষ থেকে। কোনও ওয়ারেন্ট বা আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।তাদের গন্তব্য ছিল ‘আয়নাঘর’ নামের গোপন টর্চার সেল, যা প্রথমে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, পরে ডিজিএফআই এবং র‍্যাবের অধীনে স্থানান্তর হয়।

একজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন যে তাদের দিনরাত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, নির্ঘুম অবস্থায় ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে রাখা হতো, ঝুলিয়ে পেটানো হতো। মাথার ওপর সারাক্ষণ জ্বলতো উজ্জ্বল আলো, ঘুম কেড়ে নেওয়া হতো। তাদের পরিবারকে বলা হয়েছিল, তারা “বিশেষ প্রশিক্ষণে” আছে, ফলে কোনো যোগাযোগও সম্ভব ছিল না।

তীব্র শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে, ১০ জন সৈন্যকে তাদের জীবনের ভয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল – যা সম্পূর্ণ বানোয়াট ছিল। বলা হয়েছিল যে তারা মুফতি জুবায়ের আহমেদের সাথে জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত ছিল।

এই “স্বীকারোক্তি” এর ভিত্তিতে একতরফা কোর্ট মার্শাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যাদের হাতে তারা নির্যাতিত হয়েছিলেন—সেই কর্মকর্তারাই ছিলেন কোর্ট মার্শালের ‘বিচারক’ ও ‘প্রতিপক্ষের উকিল’। নিজেরাই তদন্ত কর্মকর্তা, নিজেরাই উকিল, নিজেরাই বিচারক—একটি বিচারহীনতার দৃষ্টান্তমূলক চিত্র!

৮ জনকে ২ বছর কারাদণ্ড এবং ২ থেকে ১ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যদিও ২০২৩ সালে তাদের কারাদণ্ডের মেয়াদ ভোগ করার পর তারা মুক্তি পেয়েছিলেন, তবুও সমাজে তাদের ‘জঙ্গি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১২ বছর ধরে চাকরি করার পরও তারা ন্যায্য ভবিষ্যৎ তহবিল বা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পাননি। ঘুরেও বিমান বাহিনীর হেডকোয়ার্টার থেকে কোনো সহায়তা মেলেনি।

একজন বলেন, “আমি একজন দরিদ্র মানুষের ছেলে। ১২ বছর চাকরি করে এখন পথে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা ফেরত পেতে ৭ মাস ধরে ঘুরছি।”

ভুক্তভোগী বিমানসৈনিকদের দাবি—

১। চাকরিতে পূর্ণ পুনর্বহাল

২। পাঁচ মাসের গুম ও দুই বছরের কারাদণ্ডের ক্ষতিপূরণ

৩। বিমানবাহিনীর ‘আয়নাঘর’ এবং টর্চার সেলগুলোর তদন্ত ও উন্মোচন

৪। তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান শেখ আব্দুল হান্নানসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার

৫। চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা

তারা জাতীয় গুম কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও অভিযোগ দিয়েছেন। তাদের কণ্ঠে শুধু বিচার নয়, একটি প্রশ্নও—“দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া কি আজ বাংলাদেশে অপরাধ?”

Scroll to Top