আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের কাছে ভাতা পৌঁছানোর জন্য মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর মাধ্যমে অর্থ বিতরণ করা হয়। তবে তদন্তে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের তহবিল থেকে কমপক্ষে ১,৭১১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়াও, ই-কমার্স গ্রাহকদের লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও ১৪৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে নগদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটি ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি তৈরি করেছে, যা দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এবং এ নিয়ে একটি বিস্তৃত তদন্ত চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত ফরেনসিক অডিটে মোট প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও, গত বছরের ১৮ নভেম্বর নিযুক্ত নগদের প্রশাসক একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন, যেখানে এই তথ্যগুলো নিশ্চিত করা হয়।
ফরেনসিক অডিট অনুযায়ী, নগদ সরকারের বিভিন্ন তহবিল থেকে ১,৭১১.৪৯ কোটি টাকা ৪১টি অননুমোদিত পরিবেশকের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে। এই অর্থ মূলত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ ছিল। একই সময়ে, নগদ ১৮,২৩৩ জন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অবৈধভাবে টাকা স্থানান্তর করে, যা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এর ফলে ১৪৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। অভিযোগ রয়েছে যে এই পুরো অর্থ সাবেক এমডি তানভীর এ মিশুক ও তার গোষ্ঠী আত্মসাৎ করেছেন।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নগদ ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ও আলাদিনস ম্যাজিক ল্যাম্পসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে এবং তহবিল জব্দ করে। জনগণের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর নগদ জানায় যে, সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে এসব অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব হাসান সরকার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নগদ ইভ্যালি, আলাদিনস ম্যাজিক ল্যাম্প, সিরাজগঞ্জ শপ এবং বগুড়া শপের মতো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ১৫% থেকে ২৫% পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু সরকারের নতুন ই-কমার্স বিধিমালা কার্যকর হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ধাক্কা খায়। ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর নগদ কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অনেক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিয়ে তাদের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত নগদ ৬৪৫ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করেছে, যার বিপরীতে প্রকৃত নগদ অর্থ ছিল না এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এটি ডাক বিভাগের সঙ্গে তৃতীয় ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডের চুক্তির ৪.৬ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ অনুযায়ী, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অর্থ ইস্যু করার অধিকার রয়েছে। অনুমোদনহীনভাবে ই-মানি তৈরি করাকে বাজারে অবৈধভাবে মুদ্রা ছাড়ার শামিল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যা আর্থিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করে।
অর্থপাচারের সন্দেহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে নগদ লিমিটেডের শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়েছে। ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ক্যান্ডলস্টোন ইনভেস্টমেন্টস পার্টনার্স লিমিটেড ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এবং সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু পায়। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই ২৭ অক্টোবর সেই শেয়ারগুলো সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডে হস্তান্তর করা হয়, যা সন্দেহজনক। প্রাথমিক চুক্তিতে ৫০০ কোটি টাকার জন্য ২০% শেয়ার দেওয়া হলেও, পরে একই শেয়ার ২৩৬ কোটি টাকায় ইস্যু করা হয়। আরও ৭০% শেয়ার ধাপে ধাপে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত মিরিস হোল্ডিংস লিমিটেডের নামে ইস্যু বা হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই শেয়ার স্থানান্তরগুলোকে অর্থপাচারের অংশ হিসেবে সন্দেহ করছে এবং এ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ও অর্থপাচারবিরোধী আইনের আওতায় তদন্ত চলছে।
এছাড়াও, নগদ একটি ভুয়া রিপোর্টিং পোর্টাল তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগকে বিভ্রান্ত করে, যেখানে কোম্পানির মূল ডাটাবেজের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ই-মানির তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
২০১৮ সালের নিয়মানুসারে, শুধুমাত্র তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোই বাংলাদেশে এমএফএস পরিচালনার অনুমতি পায়। কিন্তু ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ডাক বিভাগ নগদ চালু করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই। পরে ২০২০ সালের ১০ মার্চ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ মার্চ থেকে ছয় মাসের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন দেয়। সেই অনুমোদন এরপর থেকে ৯ বার বাড়ানো হয়েছে এবং বর্তমানে তা ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বৈধ। ২০২২ সালে বিধিমালা সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমএফএস চালানোর সুযোগ থাকলেও, ডাক বিভাগ এখনও নগদকে সম্পূর্ণ আইনি কাঠামোর আওতায় আনেনি।
ডাক বিভাগ নগদের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নগদ লিমিটেডকে দেয়, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোনো বৈধ চুক্তি দাখিল করা হয়নি—শুধু ২০১৭ সালের পুরনো ডাক ক্যাশ কার্ড চুক্তি ছাড়া। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এটিকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সেবা অবৈধভাবে বেসরকারি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর হিসেবে দেখছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান ‘কালবেলা’কে জানান, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার জন্য নগদে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রয়েছে। আদালতের পরবর্তী নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বর্তমানে এমএফএস বাজার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নগদের লেনদেন মোট এমএফএস বাজারের ১৮.৬৪ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন ১,০০০ কোটির বেশি টাকার লেনদেন করে এবং এর গ্রাহকসংখ্যা ৯.৫ কোটির বেশি।