‘পদত্যাগ করতে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পা ধরেছিলেন শেখ রেহানা’

৫ আগস্ট ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। তবে পদত্যাগের আগে তিনি কঠোর হাতে ছাত্র আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলেন। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও, তিনি ক্ষমতার আসন ছাড়তে চাননি। একপর্যায়ে পদত্যাগ করতে ৫ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনার পা ধরেছিলেন শেখ রেহানা।

রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এক তদন্ত প্রতিবেদনে প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এই তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সামনে লিখিতভাবে এই তথ্য পড়ে শোনান।

প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। দেশ ছাড়ার আগে (৪ আগস্ট) সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন তিনি। তবে পরিস্থিতি যে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেটা তিনি কিছুতেই মানতে চাচ্ছিলেন না। পরে পরিবারের সদস্যরাসহ বোঝানোর পর পদত্যাগে রাজি হন তিনি। এরপর দ্রুততম সময়ে পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টারে করে গোপনে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।

৩ আগস্ট সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের তাড়িয়ে দিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পরও শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। যদিও ৩ আগস্ট রাতে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার একজন উপদেষ্টাসহ কিছু নেতা শেখ হাসিনাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। বলা হয় যে তারা সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি তা মানতে চাননি; বরং তিনি ৪ আগস্ট থেকে আরও কঠোর কারফিউ জারির জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সকাল থেকে কারফিউ কঠোর করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, সকাল ৯টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীরা কারফিউ ভাঙতে শুরু করে। সকাল ১০টা নাগাদ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ বাড়তে থাকে।

এই সময়ে, প্রধান প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালকে জানান যে ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, আছাদুজ্জামান খান কামাল তাকে পদত্যাগ করতে না করেছিলেন।

৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ডাকা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেটার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং দিয়ে দিচ্ছেন, সামরিক যানে পর্যন্ত উঠে পড়ছেন—এরপরও কেন তারা কঠোর হচ্ছে না, সেটা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্বাস করে এই কর্মকর্তাদের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন—সেটাও তিনি উল্লেখ করেন।

এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা আইজিপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেন যে, তারা (পুলিশ) ভালো করছে। এরপর আইজিপি বলেন যে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পুলিশের পক্ষে এত বেশি সময় ধরে এত কঠোর অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব নয়।

সেই সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই পরিস্থিতি জোর করে সামাল দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মানতে চাননি। এরপর কর্মকর্তারা অন্য কক্ষে শেখ রেহানার সাথে আলোচনা করেন। তারা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন এবং শেখ হাসিনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ করেন। এরপর শেখ রেহানা তার বড় বোন শেখ হাসিনার সাথে আলোচনা করেন। তিনি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে পদত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে অনড় থাকেন। এক পর্যায়ে, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথেও ফোনে কথা বলেন। এরপর জয় তার মায়ের সাথে কথা বলেন। তিনি পদত্যাগ করতে রাজি হন। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ রেকর্ড করতে চান। ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য আসে যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী শাহবাগ এবং উত্তরা থেকে গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। দূরত্ব বিবেচনা করে অনুমান করা হয়েছিল যে, বিক্ষোভকারীরা ৪৫ মিনিটের মধ্যে শাহবাগ থেকে গণভবনে পৌঁছাতে পারবে। যদি তারা ভাষণ রেকর্ড করতে দেন, তাহলে গণভবন ত্যাগ করার সময় তাদের নাও থাকতে পারে।

এরপর শেখ হাসিনা তার ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে পৌঁছান। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর শেখ হাসিনা দুপুর আড়াইটার দিকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তার ছোট বোনকে নিয়ে ভারতে উড়ে যান।

ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনা স্থানীয় সময় ভোর ৫:৩৬ মিনিটে নয়াদিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্ডন বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা তাকে স্বাগত জানান। বলা হচ্ছে যে তিনি সেখান থেকে লন্ডন যেতে পারেন।

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন গত বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোটে বিএনপি জয়ী হলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যায়। তখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা।

এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হন। পাঁচ বছর পর, ২০১৪ সালে, তিনি একতরফা নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে (দশম জাতীয় সংসদ) ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিরোধী দলগুলো সেই নির্বাচনে (দশম জাতীয় সংসদ) অংশগ্রহণ করেনি; শেখ হাসিনা এবং তার মিত্ররা একসাথে সরকার গঠন করেন। ২০১৮ সালে, বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোগের কারণে সেই নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। আর এই বছরের জানুয়ারিতে বিরোধী দলগুলি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি তার নিজস্ব দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে ‘ডামি’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। বিরোধী দল এই নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলে অভিহিত করে।

Scroll to Top