একসময় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হলেও, আজ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তৈরি পোশাক, কৃষি, প্রযুক্তি ও শিল্প খাতে ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের বেশি, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে। এই বাস্তবতায় আজ প্রশ্ন উঠেছে—বাংলাদেশ কি আসিয়ান জোটের পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত?
আসিয়ান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সংগঠন বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের অন্যতম বৃহৎ জোট। এই জোটের ১০টি সদস্য দেশের সম্মিলিত জিডিপি বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রায় ৯ শতাংশ এবং এর অভ্যন্তরীণ বাজার ৬৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের। তবে এত বিশাল অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সংযোগ এখনও সীমিত। বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে, যেখানে ইউরোপের সঙ্গে ৩১ শতাংশ এবং এশিয়ার বাকি অংশের সঙ্গে ৪২ শতাংশ। এই অপ্রতুল সংযোগ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়
যদি বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হয়, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। বিশাল যৌথ বাজারে প্রবেশাধিকার রপ্তানি আয় বাড়াবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে। শ্রমবাজারে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। পাশাপাশি, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি হলে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী শিল্পখাতে যুক্ত হয়ে দেশীয় উৎপাদন ও প্রযুক্তি খাতেও নতুন অগ্রগতি আনতে পারবে।
কৌশলগত দিক থেকেও বাংলাদেশ আসিয়ান জোটের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর এবং কক্সবাজারে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবে, যা এই অঞ্চলের আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নিয়ে আসবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের মতো স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব দেশের ভাবমূর্তিকে আরও সুদৃঢ় করেছেন। অপরদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের একক প্রভাব এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো বিকল্প সংযোগের সন্ধানে রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ কার্যকর একটি আঞ্চলিক সেতুবন্ধ হতে পারে।
বাংলাদেশ আর শুধু দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ নয়; এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সেতুবন্ধ।আসিয়ানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি কেবল একটি সদস্যপদ অর্জন নয়, এটি হবে বিশ্বের কাছে এক বার্তা, যে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব নেতৃত্বে অংশ নিতে প্রস্তুত।