সিলেটে নানা ভাই ফয়জুল খান আলম মাদকাসক্ত তরুণীদের ফাঁদে ফেলতেন। অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে তাদের ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। কেউ একবার তার ফাঁদে পড়লে তাকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। টাকা না দিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। সিলেটের শাপলা হলিডে হোমকে কেন্দ্র করে এভাবেই আলম তরুণীদের ব্ল্যাকমেইলের জালে ফেলতেন। সবাই তাকে চেনে ‘নানা ভাই’ নামে। তরুণীরা শাপলায় গেলে তাকেই নানা ভাই বলে ডাকত। সেই থেকেই এখন তার নাম হয়ে গেছে নানা ভাই।
সাম্প্রতিক সময়ে গোলাপগঞ্জের কায়স্থগ্রামের মুহিনুর রহমান ও তার বন্ধু ব্যবসায়ী আসাদের ওপর পাওনা টাকা নিয়ে হামলার ঘটনায় শাপলার কুকর্মের নানা তথ্য সামনে আসতে থাকে। ওই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর থেকেই পলাতক আলম। তার তরুণ সংঘবদ্ধ চক্রও আত্মগোপনে চলে গেছে। শাপলার অপকর্ম ফাঁস হওয়ার পর পুলিশও তৎপর হয়েছে। ইতোমধ্যে ওই হলিডে হোমে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবে আলম বা তার চক্রের কাউকে ধরা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, আলম ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
আলমের মূল বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার দত্তরাই গ্রামে। স্থানীয়রা জানান, ৫-৬ বছর আগে শাপলার প্রকৃত মালিক এক লন্ডনপ্রবাসীর কাছ থেকে ভবনটি ভাড়া নেন। নিচের তিনটি তলা রিসোর্ট হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি। ওপরের দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতেন। দ্বিতীয় তলায় নিজের পরিবার নিয়ে থাকতেন এবং নিচের তিন তলা হয়ে ওঠে তার অপরাধের ঘাঁটি। শুরুতে বারাশালা এলাকার মানুষ বিষয়টি বুঝতে পারেননি। পরে ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে যায়।
বারাশালা এলাকার কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা জানান, শাপলায় নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়। বিষয়টি ধরা পড়ে যায় যখন রাতে ও ছুটির দিনে অনেক ‘ভিআইপি’ ব্যক্তি সেখানে ছুটে যেতেন। সুন্দরী তরুণীরা আসতেন। বিশেষ করে ৩১শে ডিসেম্বর রাত ও পহেলা বৈশাখে শাপলায় জমকালো অনুষ্ঠান হতো। রাতভর চলতো নাচ-গানের আসর। এলাকার লোকজন সব বুঝেও মুখ বুঝে সহ্য করতেন।
শাপলায় কী হতো জানতে চাইলে আলমের ব্ল্যাকমেইলের শিকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শাপলা হলো অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্র। যা চান, তা-ই পাওয়া যায় এখানে। সব ব্যবস্থাই করে আলম। তার কাছে শহরের ১০-১২ জন তরুণীর ফোন নম্বর আছে। এদের বেশিরভাগই সিলেটের বাইরে থাকেন, পড়াশোনার জন্য সিলেটে আছেন। নানা ভাইয়ের ফোন পেলেই চলে আসেন। এরপর তারা অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। আর চালাক আলম গোপনে ভিডিও ও ছবি ধারণ করে রাখেন। পরে এসব দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন। মোবাইল ফোনে বহু ভিডিও ও ছবি সংরক্ষিত আছে আলমের।
গত ১৫ এপ্রিল শাপলা হলিডে হোমে হামলার শিকার মুহিনুর রহমান বলেন, যখন তাকে একটি কক্ষে আটকে নির্যাতন করা হচ্ছিল, তখন আলম ও তার ভাই তাজুল তাকে সেই ভিডিও ও ছবি দেখায়। তখন তারা বলে, “সবাই আমাদের হাতে বন্দী। আমাদের লেবেল আছে। কেউ কিছু করতে পারবে না।” মুহিন বলেন, আলম নিজেও নেশায় আসক্ত। তরুণীদের ইয়াবা ও মদ খাইয়ে আসক্ত করে ফেলেন। এরপর তাদের গোপন ছবি তোলেন। পরে সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন। অনেক তরুণী এই ফাঁদে পড়ে বন্দী হয়ে পড়েছে। ডাক পেলে না গেলে তাদেরও হুমকি দেওয়া হয়। এতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তারা।
আসক্তি তৈরি করে তাদের রিসোর্টে আসা লোকদের কাছে পাঠানো হতো। মুহিন বলেন, আলমের তরুণীদের মাদক খাওয়ানো এবং অসামাজিক কর্মকাণ্ডের অনেক ভিডিও ও ছবি বহু মানুষের হাতে রয়েছে। তিনি তা বিভিন্ন মানুষের মোবাইলে পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন।
ঘটনার পর, নানা দিক থেকে আলমের হুমকির শিকার অনেকে মুহিনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এক ব্যবসায়ী বলেন, মাদক ছিল আলমের ডেরার ওপেন সিক্রেট। শহরের জান্নাত, বৃষ্টি, তানিয়া, ইমা নামের তরুণীরা নিয়মিত যেতেন সেখানে। এছাড়াও ঢাকা থেকে কলগার্ল আনা হতো। ঢাকার নাটক ও সিনেমার অনেক অভিনেত্রীও আলমের ডাকে সাড়া দিতেন। ফলে সিলেটের বহু ভিআইপি ছুটে যেতেন সেখানে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও যেতেন। জাফলং, ভোলাগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের বড় ব্যবসায়ীরাও ছিলেন নিয়মিত অতিথি।
তিনি তার ছোট ভাই ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ক্যাডার তাজুলকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। তাজুল হলেন আলোচিত ক্যাডার পিয়ুষের সহযোগী। শাপলা হলিডে হোমটি সিলেট এয়ারপোর্ট রোডের পর্যটন মোটেলের পথে। বিপরীত পাশে পর্যটন বার। তাজুল ও তার বাহিনী দিনরাত সেই বারের নিচে বসে আড্ডা দিত।
স্থানীয়রা জানান, মুহিনের ওপর হামলার মামলার পর থেকেই পুলিশ রিসোর্টে নিয়মিত আসছে। খোঁজাখুঁজি চলছে। সে কারণেই নানা ভাই আলম পলাতক। তাজুল ও সন্ত্রাসী বাহিনী এলাকাছাড়া হয়েছে কয়েকদিন ধরে। এতে করে এলাকায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। শাপলা হলিডে হোমের বিভিন্ন অপকর্ম ফাঁস হওয়ার পর, যারা পরিবার নিয়ে ফ্ল্যাটে থাকতেন, তারাও চলে যাচ্ছেন। স্থানীয়রা জানান, আলমের কর্মকাণ্ডে আতঙ্কে তার বাসিন্দারা অন্যত্র সরে যাচ্ছেন।