আমি আর বইতে পারছি না, এই একটা চাকরি আমার জীবনটাই এলোমেলো করে দিল: মারিয়াম

মারিয়াম আখতার সাথী—বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের এক বরখাস্তকৃত সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই)। দীর্ঘ এক বছরের প্রশিক্ষণের পর নিয়োগে যোগদানের কয়েকদিন আগেই নাস্তা না খেয়ে হইচই’ করার অভিযোগে তাকে অব্যাহতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মারিয়াম আখতারের বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলায়। তাঁর বাবা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত। তিন ভাইবোনের মধ্যে মারিয়াম সবার ছোট। তিনি ঢাকা উইমেনস পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের এসআই পদে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণে যোগ দেন।

পুলিশে যোগদানের প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে মারিয়াম বলেন, “আমার ছোটবেলায় আমাদের পাশের গ্রামে এক আপুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তাঁর বিকৃত মরদেহ উদ্ধার হয়, কিন্তু অপরাধীরা কেউ ধরা পড়েনি। তখন থেকেই মনে মনে শপথ করি—পুলিশে যোগ দিতে পারলে নারীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।” তিনি আরও বলেন, “আমার বড় ভাই আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন, কিন্তু পুরো পরিবারের ভার ছিল তাঁর কাঁধে। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্বও ছিল তার নিজের পরিবারের। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করি। সারা দিন ক্লাস, অফিস, নিজের হাতে রান্না-বান্না—ছাত্রজীবনে অনেক কষ্ট করেছি। ২০২২ সালে এসআই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে কাউকে না জানিয়ে আবেদন করি এবং মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় অংশ নিই। কিন্তু পরীক্ষা শেষে আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি, কারণ আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা এতটা কঠিন হবে।”

তিনি বলেন, “অসুস্থতার কারণে বেসরকারি চাকরিটিও চলে যায়। নিজের উপর রাগ করতাম। এক বছর পর, ২০২৩ সালে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এলে আবার আবেদন করি। আল্লাহর রহমত আর নিজের কঠোর পরিশ্রমে ৪০তম ব্যাচে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। এরপর সারদায় এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণে যোগ দিই।”

তবে সেই প্রশিক্ষণ শেষে বরখাস্ত হন মারিয়াম। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস জ্বর নিয়ে, রোজা রেখে, ৬ ডিগ্রি ঠান্ডায় রক্ত কাশতে কাশতে সারদায় প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু একদিনের জন্যও মেডিকেল ছুটি নেইনি। কারণ আমি নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। সেই জেদের কারণে ইউনিফর্মের প্রেমে পড়ে যাই। আমার স্বপ্ন ছিল একজন মানবিক পুলিশ অফিসার হওয়ার। কিন্তু আফসোস, তা আর সম্ভব হলো না। প্রায় এক বছর বেতন ছাড়া প্রশিক্ষণ নিয়ে, চাকরিতে যোগদানের ১০ দিন আগে আমাকে বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ—আমি নাশতা না খেয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশৃঙ্খলা করেছি!”

তিনি আরও বলেন, “গত বছরের ৭ অক্টোবর আমাদের পাসিং আউট প্যারেডের দিন আমরা প্রতিদিনের মতো নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর মাঠ ইনচার্জ আরআই স্যার আমাদের পিএ নম্বর ডেকে ২৫২ জনকে আলাদা করে দেন। এরপর আমাদের পাসিং আউট প্র্যাকটিসের ইউনিফর্ম খুলে ফেলা হয় এবং সাধারণ প্যারেডে অংশ নিতে বলা হয়। পরদিন ‘আইন’ ক্লাসের সময় আমাদের হাতে একটি চিঠি তুলে দেওয়া হয়, যাতে লেখা ছিল—আমরা ২৫২ জন বরখাস্ত হয়েছি। এরপর ২১ তারিখে বরখাস্তপত্র দেওয়া হয়।” মারিয়াম বলেন, “যেদিন বরখাস্তপত্র পেলাম, মাথা কাজ করছিল না। বুঝতেই পারছিলাম না, আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো কীভাবে এলো? আমি তো আমার প্রতিদিনের রুটিন মেনেই চলেছি। কখন, কীভাবে বিশৃঙ্খলা করলাম? আমি জীবনে কখনও রাজনীতি করিনি, আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, চাকরি পাওয়ার জন্য কোনো সুপারিশও করিনি। তবুও আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি—কেন আমাকে বাদ দেওয়া হলো? যদি সঠিক কারণটা জানতাম, অন্তত নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম।”

তিনি আরও বলেন, “সেদিন আমি কোনো বিশৃঙ্খলা করেছিলাম কি না, তা একাডেমির সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমি চাই, যথাযথ তদন্ত হোক।” মারিয়াম বলেন, “আমার বরখাস্তের খবর শুনে সেদিন রাতেই আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। আমার বড় ভাই পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ চলাকালীন আমাকে সবভাবে সহযোগিতা করেছেন। বৃদ্ধ বাবা-মা অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে আছেন। আমি ভাবতাম, চাকরি পেলে ভাইয়ের সঙ্গে মিলে পরিবারকে সামলে নেব। কিন্তু এই একটি চাকরি—আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিল, আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দিল।” তিনি বলেন, “আমি ভাইদের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারি না, মা-বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। প্রতিবেশীদের কটু কথা সহ্য করতে হয়। নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার কথা মনে হয়। এই অভিশপ্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাকে মানসিকভাবে মেরে ফেলেছে। মিথ্যা অভিযোগের এই ভার আমি আর বইতে পারছি না।”

Scroll to Top