ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের নাম ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে শপথ নেওয়ার পরও তিনি কতদিন মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে আইনি অনিশ্চয়তা।
আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ না করেই রোববার রাতে গেজেট প্রকাশ করেছে ইসি। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন—এটা কি রাজনৈতিক চাপে নেওয়া সিদ্ধান্ত? গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের সব মেয়র, কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
চলতি বছরের ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা ও নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নূরুল ইসলাম ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়র ঘোষণা ও গেজেট প্রকাশকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত তা বাতিল করেন। তবে সেই নির্বাচনের মেয়র হিসেবে মেয়াদ শেষ হবে ১৫ মে। ফলে শপথ নেওয়ার পর ইশরাক হোসেন মেয়র হিসেবে কতদিন দায়িত্ব পালন করবেন, সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
২০২০ সালে ইশরাক হোসেন ওই নির্বাচনের ফলাফল ও গেজেট বাতিলের দাবিতে নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। শুরুতে তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করার আবেদন করেননি। কিন্তু আদালতের রায়ে তাকে মেয়র ঘোষণা করার পর, ইসিও দ্বিধায় পড়ে। এজন্য ইসি আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে মঙ্গলবার একটি চিঠিও পাঠায়।
পরে গত বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইশরাক হোসেন। তিনি জানতে চান, আদালতের রায় থাকলেও কেন গেজেট প্রকাশে দেরি হচ্ছে। এরপরই রোববার রাত ১০টা ৩০ মিনিটে গেজেট প্রকাশ করে ইসি, যেখানে বিএনপি নেতা ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন—তবে কি ইশরাকের চাপেই আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়েই গেজেট প্রকাশ করেছে ইসি?
প্রাক্তন স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, “এই নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। তারা যদি এখন থেকেই চাপে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কীভাবে নিশ্চিত করবে? তখন এই প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ, বিতর্ক আর অবিশ্বাস তৈরি হবে।”
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমদ বলেন, “আমাদের ওপর চাপ ছিল নৈতিক। গেজেট প্রকাশের সময়সীমা ছিল। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কমিশনের অনুভব ছিল এমন, তাই আমরা গেজেট প্রকাশ করেছি।”
শপথের পর মেয়াদ কতদিন?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। এতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফজলে নূর তাপস ৪ লাখ ২৪ হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন, আর বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন পান ২ লাখ ৩৬ হাজার ভোট। ওই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগও ওঠে।
নির্বাচনের এক মাস পর, ৩ মার্চ, ইশরাক হোসেন ভোটে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিলের আবেদন করে মামলা করেন। এরপর ২৭ মার্চ, নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের রায়ের ভিত্তিতে ইসি নতুন গেজেট প্রকাশ করে, যেখানে তাপসকে সরিয়ে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর, গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের—including ঢাকার দুই সিটির—অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। ফলে বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মেয়রের পদ শূন্য। সেই পদে প্রশাসক দায়িত্ব পালন করছেন।
গেজেট প্রকাশ করে উপনির্বাচনের পরিবর্তে কাউকে মেয়র ঘোষণা করার ফলে এখন প্রশ্ন উঠেছে—ইশরাক হোসেন কতদিন এই পদে থাকতে পারবেন? প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এই সিটির মেয়রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৫ মে। সেহেতু শপথ নেওয়ার পর তার মেয়াদ কতদিন হবে, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বর্তমান আইনে সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ আর মাত্র ১৫-১৬ দিন। সেই হিসাবে যদি নতুন নির্বাচনসূচি ঘোষণা হয়, তাহলে ইশরাক হোসেনকে প্রার্থী হতে হলে এই সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।”
আর যদি এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনসূচি ঘোষণা না হয়, তাহলে কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক আহমেদ বলেন, “বর্তমান আইনে এই বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলা নেই। তবে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে—মেয়াদ শেষে ভোট না হলে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার কথা।” তাঁর মতে, এর আগে এমন পরিস্থিতি কখনও হয়নি। তাই শপথ নিলেও ইশরাক হোসেন কতদিন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, তা নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে।