বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফরুক আহমেদ তার নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে ১২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন — এমন একটি খবর ক্রিকেট মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে, আসলেই কি তাই? যে ব্যক্তিকে বিসিবিকে দুর্নীতিমুক্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি নিজেই কি এমন করলেন? তবে, গতকাল ভিন্ন একটি তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ফরুক আহমেদ ১২০ কোটি নয়, বরং ২৩৮ কোটি টাকার এফডিআর ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন। আগের বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এই টাকা দুই-তিনটি ব্যাংকে জমা রেখেছিলেন, যেখান থেকে বিসিবির তেমন কোনো মুনাফা হচ্ছিল না। তাই নতুন সভাপতি ২৩৮ কোটি টাকা ১৩টি ভিন্ন ব্যাংকের স্থায়ী আমানতে (এফডিআর) রেখেছেন, অধিক মুনাফার আশায়। এ বিষয়ে বিসিবি গতকাল ব্যাখ্যা প্রদান করেছে এবং যে ব্যাংকগুলোতে টাকা রাখা হয়েছে, সেগুলোর বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ফরুক আহমেদ দৈনিক মানবজমিনকে বলেন, ‘আমরা ১২০ কোটি নয়, প্রায় ২৩৮ কোটি টাকার এফডিআর ১৩টি ব্যাংকে রেখেছি। যেখান থেকে আমরা বেশি মুনাফা পাচ্ছি। পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলো আমাদের বিভিন্ন টুর্নামেন্টেও স্পনসর করছে।’ তবে অভিযোগ উঠেছে, ফরুক আহমেদ অন্য পরিচালকদের পাশ কাটিয়ে একক নির্বাহী ক্ষমতায় এই কাজটি করেছেন। এ বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, বিসিবির ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় বোর্ডের অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান ফাহিম সিনহা ও টেন্ডার ও ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আনামের স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ব্যাংকিং বিষয়ে বিসিবি সভাপতির কোনো স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফাহিম সিনহা বলেন, ‘আমাদের বিসিবি সভাপতি আমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা শুনেছি, তবে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়নি। হয়তো টাকা রাখার বিষয়ে আরও কিছু পরামর্শ দেওয়া যেত। তবে বিসিবির স্বার্থে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর রাখা অনৈতিক নয়। সত্যি বলতে, আমাদের এসব আলোচনা অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাইরে এ বিষয়ে কথা বলা উচিত নয়।’ তবে, মাহবুবুল আনামের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গত কয়েকদিন ধরে জাতীয় কিছু সংবাদমাধ্যমে বোর্ডের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা বিসিবির নজরে এসেছে। বিসিবি জানিয়েছে, এসব প্রতিবেদন ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং বোর্ড ও সভাপতি ফরুক আহমেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছে।
বিসিবি তাদের বিবৃতিতে এফডিআর স্থানান্তর নিয়েও ব্যাখ্যা দিয়েছে। বিসিবি জানায়, “২০২৪ সালের আগস্টে বিসিবির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর ফরুক আহমেদ বোর্ডের আর্থিক স্বার্থ রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন। পূর্ববর্তী বছরের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর দেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।”
“এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, বিসিবি তার ব্যাংকিং সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করে এবং কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ‘গ্রিন’ ও ‘ইয়েলো’ জোনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথেই লেনদেন করা হবে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিসিবি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক থেকে ২৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করে এবং ২৩৮ কোটি টাকা গ্রিন ও ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলিতে পুনঃবিনিয়োগ করে। বাকি ১২ কোটি টাকা বিসিবির বিভিন্ন পরিচালন ব্যয় মেটানোর জন্য নির্ধারিত একাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছে।”
“উল্লেখযোগ্য যে, বোর্ডের ডিরেক্টরদের জ্ঞাতসারে ছাড়া ব্যাংক পরিবর্তন বা লেনদেন সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত সভাপতি এককভাবে নেন না। বিসিবির আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বোর্ডের দুই পরিচালক স্বাক্ষরকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন — যথাক্রমে বোর্ডের অর্থ কমিটির চেয়ারম্যান ফাহিম সিনহা এবং টেন্ডার ও ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আনাম। বিসিবি সভাপতি এই ক্ষেত্রে স্বাক্ষরকারী নন।”
বিসিবি আরও জানায়, “কিছু বিশেষ সুবিধাভোগী মহল ও ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী, যারা ক্রিকেট প্রশাসনেও সক্রিয়, বোর্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে। এ কারণে বিসিবির আর্থিক নিরাপত্তা আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিসিবি তাদের টাকা ও স্থায়ী আমানতের নিরাপত্তা ১৩টি নির্ভরযোগ্য ব্যাংকের হাতে তুলে দিয়েছে। এর ফলে বিসিবির আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি মুনাফাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের তুলনায় এফডিআর থেকে ২-৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
গত ছয় মাসে বিসিবি তার তিনটি ব্যাংকিং পার্টনারের কাছ থেকে প্রায় ১২ কোটি টাকার স্পনসরশিপ পেয়েছে। এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য পার্টনার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা এই আর্থিক সম্পর্কের দৃঢ়তা প্রমাণ করে।
বিসিবি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা সর্বোচ্চ মানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বজায় রাখবে এবং তথ্যভিত্তিক যেকোনো তদন্ত ও পর্যালোচনাকে স্বাগত জানাবে।