দুই উপদেষ্টার এপিএস ও পিও’র বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ, হাতিয়েছেন শতকোটি টাকা

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সহকারী একান্ত সচিব (APS) মোয়াজ্জেম হোসেন এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি এবং ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও।

অভিযোগে বলা হয়, তারা তিনজন বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ, বদলি এবং সরকারি প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে তদবির করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিশেষ করে, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ স্বৈরাচারপন্থী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের নামে তারা এ দুর্নীতি করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পানি সম্পদ, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তারা নিয়মিত তদবির করতেন। অভিযোগ ওঠার পর সরকার ২১ এপ্রিল মোয়াজ্জেম হোসেন ও তুহিন ফারাবিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। অন্যদিকে ডা. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন, এবং তার দেশে ফিরে আসা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

আসিফ মাহমুদ সাজিব ভূঁইয়ার সাবেক APS মোয়াজ্জেম হোসেন একসময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়োগ-বদলি, টেন্ডার ও প্রকৌশলীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে উপজেলা প্রকৌশলীর পদেও বদলির তদবির করতেন তিনি।

বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র, পানি সম্পদ, গণপূর্ত ও সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে ঠিকাদারদের হয়ে কাজ করাতে তদবির করতেন তিনি। বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সচিবালয়ে অবস্থান করে এসব তদবির করতেন যাতে মিডিয়ার নজর এড়িয়ে যাওয়া যায়। বহু কর্মকর্তা তাদের এড়িয়ে চলতেন, ফলে মোয়াজ্জেম যা চাইতেন, তাই পেতেন।

মোয়াজ্জেম এমনকি অস্ত্র, গুলি, শটগানসহ পুলিশের বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয়ের বিল ছাড় করাতে তদবির করতেন বলেও জানা গেছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রকৌশলীদের বদলি, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বদলির জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিতেন তিনি।

এছাড়া, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রেও তিনি অর্থের বিনিময়ে তদবির করতেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্বৈরাচারপন্থী প্রকৌশলীদের পুনর্বাসনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, অথচ স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তুহিন ফারাবি ও মো. মাহমুদ — যাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে — তারা ডাক্তার, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, পরিচালক, উপপরিচালক ও সিভিল সার্জনদের নিয়োগ-বদলির নামে ১৫ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন।

তারা স্বাস্থ্যসেবার একজন জ্যেষ্ঠ সচিবকে রাজি করিয়ে এসব বদলি সম্পন্ন করাতেন। নার্স ও মিডওয়াইফ বদলির জন্য ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন। এমনকি হজ দলেও ডাক্তার-নার্সের নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

গত ৮ আগস্টের পর তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসান কয়েকজন ডাক্তার বদলি করেন, যার জন্য ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়। নতুন ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা কমিশনের বিনিময়ে কাজ করতেন, যেখানে আগের ঠিকাদাররা পালিয়ে গিয়েছিল।

তুহিন ফারাবি ইতিমধ্যে অব্যাহতি পেলেও ডা. মাহমুদ এখনও সুস্থ অবস্থায় আছেন এবং রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং তুহিনের মাধ্যমে নিয়োগ পান। তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “আমাকে অপসারণ করা হয়নি। আমি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। আগামী মাসে আমার পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) মৌখিক পরীক্ষা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরীক্ষার ভাইভাও দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এসব কারণেই আমি পদত্যাগ করেছি।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ৪০০ কোটি টাকা তদবিরের মাধ্যমে আত্মসাতের যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন,
“আমি এক টাকাও দুর্নীতি করেছি—এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।”

অন্যদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (ছাত্র প্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি এবং বর্তমান কর্মকর্তা মো. মাহমুদের সঙ্গে কথা বলতে মন্ত্রণালয়ে গেলে জানা যায়, তারা কেউই অফিসে উপস্থিত নেই।
তুহিন ফারাবিকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, আরেক ব্যক্তি মাহমুদুল হাসান বর্তমানে একজন রোগীর সঙ্গে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন।
তাদের উভয়ের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

Scroll to Top