গাজী সালাউদ্দিন তানভীর, নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি (এনসিপি)-এর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং দলের যুগ্ম সদস্য সচিব, লবিং ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে বলে জানা গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে, তাকে সাময়িকভাবে এনসিপি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। দলটি তার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছে।
এ বিষয়ে গাজী সালাউদ্দিন তানভীর সোমবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, “দলীয় ফোরামে আমাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগের লিখিত জবাব আমরা উপস্থাপন করব। এরপর বিষয়টি গণমাধ্যমেও জানানো হবে।”
গাজী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে লবিং ও প্রভাব বিস্তারের নানা গুঞ্জন সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে শোনা গেলেও, এতদিন কেউ প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কথা বলেননি। তবে সম্প্রতি দলের সাধারণ সভায় বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখন দলের ফোরাম থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে। এরপর সোমবার তাকে দল থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বাসা) সভাপতি ড. আনোয়ার উল্লাহ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, গাজী সালাউদ্দিন তানভীর একসময় ছাত্র সমন্বয়ক ছিলেন। এখন তিনি একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সত্যতা রয়েছে। না হলে দল তাকে বরখাস্ত করত না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাটি আরও তদন্তের জন্য তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এই উদ্যোগ এনসিপির পক্ষ থেকেই নেওয়া যেতে পারে। যদি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত ক্যাডার কর্মকর্তা সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গাজী সালাউদ্দিন ইতিমধ্যে লবিং ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার এবং গৃহায়নসহ একাধিক মন্ত্রণালয় তার লবিং কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সোমবারও তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় মন্ত্রণালয়ের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে তাকে ব্যক্তিগত আলোচনায় দেখা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের নিচে সহকর্মীদের নিয়ে অবস্থান করার পর গাজী সালাউদ্দিন দাবি করেন, তিনি জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক।
তানভীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো পদে নেই। ফলে, সচিবালয়ে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত অনুমতি বা পাস তার থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি ‘কূটচালের’ মাধ্যমে সচিবালয়ে প্রবেশের পাস আদায় করে নেন। প্রশাসনের কেন্দ্রস্থল সচিবালয়ে প্রবেশাধিকারকে কাজে লাগিয়ে সালাউদ্দিন সেখানে একটি প্রভাবশালী চক্র গড়ে তোলেন। তিনি বিশেষভাবে বিভিন্ন ব্যাচের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
গত বছরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর একযোগে দেশের ৫৩টি জেলায় ডিসি (জেলা প্রশাসক) নিয়োগ দেওয়া হয়। সালাউদ্দিন ওই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কাজে লাগান। ওই নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র নিয়োগ ও মাঠ প্রশাসন শাখায় কর্মরত ২০তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং যুগ্ম সচিব কে. এম. আলী আজমের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। ড. জিয়াউদ্দিনের কক্ষে তিন কোটি টাকার ব্যাংক চেক পাওয়া যায়। বলা হয়, এই টাকা ডিসি নিয়োগের অগ্রিম অর্থ হিসেবে তাকে প্রদান করা হয়েছিল। গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের সঙ্গে এই দুই কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একপর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সম্পৃক্ততার অভিযোগও উঠে আসে।
এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে কে. এম. আলী আজমকে প্রথমে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়। ড. মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদকেও অন্যত্র বদলি করা হয়। সিনিয়র সচিবের বিরুদ্ধে ১০ কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ তদন্তে সরকার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। তবে তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি।
এই ঘটনার একপর্যায়ে ডিসি পদে নিয়োগ বঞ্চিত ৩০-৩৫ জন কর্মকর্তা কে. এম. আলী আজমের কক্ষে ঢুকে তার ওপর হামলা চালান। তারা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। তিনি ভয়ে বাথরুমে আশ্রয় নেন এবং কর্মকর্তারা তাকে প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসে তাকে উদ্ধার করেন।
এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যুগ্ম সচিব কে. এম. আলী আজম ও গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীর প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সচিবালয়ে অবস্থান করতেন। তারা সচিবালয়েই একসঙ্গে মধ্যাহ্ন ও রাতের খাবার খেয়ে রাত করে বাসায় ফিরতেন। কে. এম. আলী আজম তানভীরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। তানভীরের বিরুদ্ধে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) কাগজ সরবরাহে ৪০০ কোটি টাকার কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে, গাজী সালাউদ্দিন আহমেদ তানভীরের বিরুদ্ধে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলে, এক সরকারি উপদেষ্টা যুগান্তরকে বলেন, “আমরা গাজী সালাউদ্দিন তানভীর নামে কাউকে চিনি না। আমরা তার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করব এবং তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব।” এ কথা তিনি ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন। কিন্তু গত সাত মাসেও দেশের কোনো থানায় গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে কোনো জিডি বা মামলা হয়নি। বরং, অনেকে মনে করেন, তাকে নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব পদে বসিয়ে তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও ‘অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন এমপ্লয়িজ ইউনিটি ফোরাম’-এর সভাপতি এবিএম আবদুস সাত্তার ১৯ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডিসি নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে জনপ্রশাসন সচিবের বিরুদ্ধে থাকা প্রতিবেদনটি জাতির সামনে প্রকাশ করা উচিত। সরকারের উচিত স্বচ্ছতার স্বার্থে এটি প্রকাশ করা।