গণ-অভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, যার মাধ্যমে তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। হাজারো শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে, আওয়ামী লীগ এখন আরও ভয়ঙ্কর ফ্যাসিস্ট রূপে ফিরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে। উদ্বেগজনকভাবে, দলটি দেশের ভেতরে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ঢাকা সহ বিভিন্ন এলাকায় তারা ঝটিকা মিছিল করছে। যদিও এখনো অনেকটা গোপনে, তবুও প্রকাশ্য সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিচ্ছে তারা। শুরুতে তাদের মিছিলে অংশগ্রহণকারী কম থাকলেও, ক্রমেই সেই সংখ্যা বাড়ছে।
মাত্র আট মাস আগে নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর আবারও আওয়ামী লীগের এমন সক্রিয় হয়ে ওঠা এবং প্রকাশ্যে ঝটিকা মিছিল করার সাহস অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কারা তাদের পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে? কার আশ্রয়ে তারা আবার রাস্তায় নামছে? সন্দেহের তির পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দিকেও। বিশ্লেষকদের মতে, প্রশাসনের ভেতর থেকে নীরব সমর্থন ছাড়া এত বড় গণহত্যার পর আওয়ামী লীগের এমন সাহসিকতা সম্ভব নয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রশাসনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আওয়ামীপন্থী কিছু গোষ্ঠী কৌশলে তাদের উসকানি ও সমর্থন দিচ্ছে।
কেউ কেউ মনে করেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তৃতীয় শক্তির উত্থান ঠেকাতে যারা ‘ইনক্লুসিভ নির্বাচন’-এর গল্প তৈরি করছে, তারাই গোপনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি তাদের সংসদে বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার চক্রান্তও চলছে। যদি এই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সফল হয়, তাহলে ‘জুলাই গণহত্যা’র বিচারও হয়তো রাজনৈতিক মামলার জালে আটকে পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করছেন—যদি দ্রুত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা হয়, তাহলে তাদের অস্থিতিশীল তৎপরতা আরও বাড়বে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে দলটি আবার পূর্ণ শক্তিতে ফিরে আসবে, এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও অস্থির হয়ে উঠবে—যার খেসারত দিতে হবে পুরো জাতিকে। এমনকি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও, আওয়ামী লীগ তিন বছরের মধ্যেই সরকারকে ব্যর্থ করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করবে। দেশি-বিদেশি চক্র আওয়ামী লীগকে আবার রাজনীতির মাঠে ফিরিয়ে আনার জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে এবং বিকল্প পরিকল্পনাও হাতে রেখেছে।
এই পুনরুত্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (দক্ষিণাঞ্চল) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেন, “যেদিন থেকে আমাদের আওয়ামীবিরোধী অবস্থান আর আপোষের রাজনীতির বিরোধিতাকে ‘অশিষ্টতা’ বলা শুরু হলো, সেদিন থেকেই আওয়ামী লীগের মিছিল বাড়তে শুরু করেছে।” তিনি আরও লেখেন, “যারা আপোষের রাজনীতি করছেন, তাদের সতর্ক করছি—অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন। না হলে আপনারা করবেন আপোষের রাজনীতি, আর আমি করব ‘অশিষ্ট’ আচরণ। আমি যদি ‘অশিষ্ট’ আচরণ শুরু করি, সেটা আপনারা সামাল দিতে পারবেন না। সাবধান।”
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রতিবেশী ভারত পুরোপুরি আওয়ামী লীগের পাশে রয়েছে, এবং তাদের মনোবল ও কৌশলগত সাহস জোগাচ্ছে। দেশি-বিদেশি অনেক শক্তি গোপনে আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। বিদেশ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ কালো টাকা ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। এ কারণেই বিতাড়িত দলটি রাজনীতিতে ফিরে আসার সাহস পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই ৩৬ আন্দোলনে অংশ নেওয়া জোটের ভেতর বিভাজন তৈরিতে আওয়ামী এজেন্টরা ইতোমধ্যে সফল হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বড় দলগুলোর সঙ্গে আপোষ করেও সক্রিয় হচ্ছে আওয়ামী লীগ। এই দুইটি কারণ তাদের মিছিল বড় হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের পতন ঘটে। প্রাণভয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। এর আশপাশের সময়ে বেশিরভাগ মন্ত্রী, এমপি ও শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়ে পালান। যারা পালাতে পারেননি, তারা আত্মগোপনে যান বা গ্রেফতার হন। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে আওয়ামিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। একই সঙ্গে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। এরপর ওই বছরের ২৩ অক্টোবর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে রহস্যজনক কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে।
গত এক সপ্তাহে অন্তত চারটি জায়গায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল হয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার উত্তরার উত্তরখান ইউনিয়নে দলটির সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান মিলনের নেতৃত্বে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
শুধু মিছিল নয়, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সদস্যরা আন্দোলনের দুই সমন্বয়কারীর ওপর হামলা চালায়। চট্টগ্রামের ওয়াসা মোড়ে আন্দোলনের সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ ও রাসেল আহমেদকে অবরুদ্ধ করে হামলা চালানোর অভিযোগও উঠেছে। এর পরই সরকার সক্রিয় হয়ে ওঠে। শনিবার ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী অঙ্গসংগঠনের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, আওয়ামী লীগ যেন মিছিল করতে না পারে, সে জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শনিবার রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এ নির্দেশ দেন। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নে তিনি জানান, ইতোমধ্যে দুইজনকে আটক করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে না। তবে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে অপরাধ করেছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা না হলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।”
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম)-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, “বাংলাদেশে যেন ফ্যাসিজম আর কখনো মাথা না তোলে, তার জন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে। এটাই হবে সবচেয়ে বড় সংস্কার। তা না হলে এর খেসারত দিতে হবে দেশের মানুষকে।”