নব্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি: আওয়ামী লীগ থাকবে, তবে নেতৃত্বে থাকবেন না শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগ থাকবে, কিন্তু নেতৃত্বে শেখ হাসিনা থাকবেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নেতারাও থাকবেন না। বর্তমান আওয়ামী লীগের কয়েকজন পরিচিত মুখকে সামনে রেখে একটি নতুন বা তথাকথিত “পরিচ্ছন্ন” আওয়ামী লীগ গঠনের পরিকল্পনা বাংলাদেশে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব এই উদ্যোগকে ‘প্রতারণা’ এবং ‘তাদের দলকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত করছে। ভারতের কিছু কূটনীতিকও মনে করেন, যদি শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে নতুন একটি আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তাহলে সেটা দিল্লির জন্য সুখকর হবে না। কারণ, এই নতুন পরিকল্পনায় যেসব নেতার নাম উঠে আসছে, তাঁদের ভাবমূর্তি আদৌ পরিচ্ছন্ন নয়—অনেকে আবার পাকিস্তানঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। ভারতের এক প্রাক্তন কূটনীতিক বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কিছু করণীয় নেই। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু। যদি এই দলের নেতৃত্ব পাকিস্তানপন্থীদের হাতে চলে যায়, তবে তা ভারতের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের শামিল হবে।”

কয়েক সপ্তাহ আগে, জুলাই আন্দোলনের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি)-র নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্ট বাংলাদেশে আলোড়ন তোলে। সেই পোস্টে হাসনাত দাবি করেন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান একটি ব্যক্তিগত বৈঠকে তাঁদের বলেন, যদি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা হিসেবে পরিচিত সাবেক স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং সাবেক এমপি সাবের হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে। হাসনাত লিখেছেন, “আমাদের বলা হয়েছে— যাঁরা রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের অংশ হবেন, তাঁরা এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবেন, শেখ হাসিনাকে অস্বীকার করবেন এবং ঘোষণা করবেন যে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনবেন।”

আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, “হাসনাতের পোস্ট আসার আগেই আমরা এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারি। এসব নাম নতুন নয়। তারা এটা দেখাতে চায় যে, নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ অংশ নিচ্ছে। কিন্তু এটা একটা প্রতারণা। মানুষকে এভাবে বিভ্রান্ত করা যায় না।” তিনি আরও বলেন, “২০০৬ সালেও যখন সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন পশ্চিমা শক্তি শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে অন্য কয়েকজন নেতাকে নিয়ে নতুন আওয়ামী লীগ গঠনের চেষ্টা করেছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছিল।
এবারও তেমনটাই হবে।” তাঁর মতে, যেমন ভারতের কংগ্রেস পার্টি গান্ধী পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তেমনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। এই দুই পরিবারের রাজনীতিতে ত্যাগ ও অবদানও অনেক। যেমন রাহুল গান্ধী তাঁর ঠাকুমা ও বাবাকে হারিয়েছেন, তেমনি শেখ হাসিনা হারিয়েছেন তাঁর বাবা-মা ও ভাইসহ পুরো পরিবারকে। ওই নেতা বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীরাও জানে, হাসিনাহীন আওয়ামী লীগ টিকবে না। তাদের আসল উদ্দেশ্যই হলো আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা।”

কলকাতায় আত্মগোপনে থাকা এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, বর্তমানে এই ‘রিফাইন্ড’ ষড়যন্ত্রই তাঁদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে— যদি তাঁরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তবে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এবং এলাকায় ফিরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। অন্যথায় তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিনি জানান, কয়েকজন বিএনপি নেতা এবং সেনা-সমর্থিত ব্যবসায়ী ফোন করে এই প্রস্তাব দিচ্ছেন। হাসিনা-ঘনিষ্ঠ এই নেতা আরও দাবি করেন, কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন নেতাও এই ষড়যন্ত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং অন্যদেরও এতে টানার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, “যাঁদের পরিচ্ছন্ন বলা হচ্ছে, তাঁদের কেউই আসলে পরিচ্ছন্ন নন। তাঁদের অনেকেই চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই তাঁরা দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।”

এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কী করছে আওয়ামী লীগ?

ওই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জানান, আওয়ামী লীগ নেতারা জেলায় জেলায় ভার্চুয়াল মিটিং করছেন। শেখ হাসিনা নিজে এই মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে তিনি কর্মীদের কথা শুনছেন এবং তাঁদের আশ্বস্ত করছেন: “ওদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। আমি যেহেতু বেঁচে আছি, শিগগিরই ফিরব। আমাদের কর্মীদের উপর হওয়া সব নির্যাতনের বিচার করব।” ৬৪ জেলার মধ্যে ২৩টি জেলার কর্মীদের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠক শেষ হয়েছে। হাসিনা বলছেন, “আমি দেশ ছাড়তে চাইনি। আমি ইস্তফাও দিইনি। আমাকে জোর করে বিমানে তুলে দেশছাড়া করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র করে আমার সরকার ফেলা হয়েছে। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।”

Scroll to Top