অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশ ঝুঁকিতে পড়তে পারে: মির্জা আব্বাস

মির্জা আব্বাস বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। সাবেক এই মন্ত্রী সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে আলোচনায় রয়েছেন—১৯৯০-এর দশকে তিনি একক ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। তিনি কালবেলার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, বিএনপির পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বিরুদ্ধে চালানো নেতিবাচক প্রচারণা এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরাসহ নানা বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম।

কালবেলা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
মির্জা আব্বাস: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু সাফল্য দৃশ্যমান ও ফলপ্রসূ হলেও অন্য উপদেষ্টাদের কোনো দৃশ্যমান সাফল্য দেখছি না। আশা করি, সংস্কার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হবে এবং নির্বাচন দ্রুতই অনুষ্ঠিত হবে।

কালবেলা: ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আজ (বুধবার) বিএনপি আবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে। কী আলোচনা হবে?
মির্জা আব্বাস: ১৭ বছর ধরে আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে মাঠে আছি। এখনও সেই দাবিতেই অটল আছি। কোনো নতুন দাবি নেই। আমি ভেবেছিলাম এই সরকার স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন দেবে। কারণ, আজ পুরো বিশ্ব গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে, একটি অগণতান্ত্রিক দেশ টিকতে পারে না। ড. ইউনূস বলেছিলেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। আবার তিনি জুনের কথাও বলছেন, কিন্তু বর্ষার কারণে জুন উপযুক্ত সময় না। এই জুনের কথা আমাদের বিভ্রান্ত করছে। তাহলে সঠিকটা কী?

প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর বলছেন, আরেকজন জুন বলছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, জনগণ নাকি এই সরকারকে পাঁচ বছর দেখতে চায়! এসব পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত ও সন্দিহান করছে। এজন্যই আমরা আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছি, বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে।

পাশাপাশি পত্রিকায় দেখলাম, প্রধান উপদেষ্টা দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। অর্থাৎ তিনি নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী। তবে সরকারের ভেতরে এবং তার আশেপাশে থাকা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী তাকে বিভ্রান্ত বা প্রভাবিত করতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি।

কালবেলা: বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করছে, কিন্তু সরকার সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না। এবার কী ভাবছেন?
মির্জা আব্বাস: দেখা যাক, আজকের আলোচনায় কী হয়। কী বলা হয়, সেটি শোনার পর আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

কালবেলা: সাধারণত নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে। তবে ৫ আগস্টের ঘটনার পর আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে নেই। নতুন দলগুলো বিএনপির জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ হবে?
মির্জা আব্বাস: সেটা নির্বাচনের সময়ই বোঝা যাবে। নির্বাচন শুরু হোক, তারপর দেখা যাবে। এখনো নির্বাচন শুরু হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী, বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করবে।

কালবেলা: বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা না দিলেও জামায়াতে ইসলামি ও এনসিপি প্রচার শুরু করেছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
মির্জা আব্বাস: আমরা বলেছি, এই সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দিলে তবেই আমরা নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করব। এখনও নিশ্চিত না তারা আদৌ নির্বাচন দেবে কি না। হয়তো অন্যরা আশ্বাস পেয়েছে, তাই আগেভাগেই কাজ শুরু করেছে।

কালবেলা: নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক মাধ্যমে আপনার ও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত নেতিবাচক প্রচারণা চলছে। কারা করছে এসব?
মির্জা আব্বাস: আওয়ামী লীগই এটা করছে, আরও দুটি রাজনৈতিক দলও জড়িত। উদ্দেশ্যমূলকভাবে করছে। এখন তাদের কাছে টাকা আছে। তারা সামাজিক মাধ্যমে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। তারা মির্জা ফখরুল, আমীর খসরু, সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং আমার বিরুদ্ধে কথা বলছে। অথচ আমরা ২০–২৫ বছর ধরে রাজপথে আন্দোলন করেছি, জেল খেটেছি—তখন কেউ কিছু বলেনি। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনেও এসব হয়নি। এখন কেন বলছে? কারণ, তারা এখন আমাদের বিরোধী মনে করছে। কিন্তু আমরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি, শত্রু না।

কালবেলা: বিএনপি কি এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে?
মির্জা আব্বাস: সবাই দেখছে, এই নেতিবাচক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা কীভাবে চলছে। অবশ্যই আমরা এর মোকাবিলা করব।

কালবেলা: ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে সারা দেশে জমি দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।
মির্জা আব্বাস: বিএনপি একটি বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হচ্ছে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে। কেন এমন ভাবছে, জানি না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী অস্থির হয়ে উঠেছে এই চিন্তায়। তারাই বিএনপি কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগ করছে।

আসলে, আমি যা দেখেছি ও জানি, একটি পুরনো ও একটি নতুন রাজনৈতিক দল সংগঠিতভাবে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চাঁদাবাজিতে জড়িত। তারা খোলাখুলিই করছে। তারা বলছে, তাদের অর্থের উৎস প্রকাশ করা যাবে না। এর মানে কী? টাকা কোথা থেকে আসছে বলতে না পারলে সন্দেহ হয়। আমরা বুঝি, আমরা বোকা নই। অন্যরা চাঁদাবাজি করছে, আর দোষ দিচ্ছে বিএনপিকে—এটা হতে পারে না। বিএনপি চাঁদাবাজিতে জড়িত নয়। শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হয়েছিল, আমরা কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের নেতা তারেক রহমান অনেককে বহিষ্কার করেছেন। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অন্যায়।

কালবেলা: আপনার বিরুদ্ধেও রেলওয়ে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে।
মির্জা আব্বাস: এটা সম্ভবত ২০০৬ সালের একটি পত্রিকার প্রতিবেদন হুবহু কপি-পেস্ট করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা ছড়াচ্ছে। ব্লগাররাও ছড়াচ্ছে। স্পষ্ট করে বলি—শাজাহানপুর এলাকার অর্ধেকটাই আমার পৈত্রিক এবং আত্মীয়স্বজনের জমি। ১৯৫৭-৫৮ ও ১৯৫৯-৬০ সালে রেলওয়ে জমি অধিগ্রহণ করে। এখন বলা হচ্ছে আমি রেলওয়ের জমি দখল করেছি! বরং রেলওয়ে আমাদের জমি দখল করেছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তারা জানুক—আমার পরিবার আট প্রজন্ম ধরে এই জমিতে বসবাস করছে। তখন ঢাকায় রেলওয়ে ছিল না। আমরা আগে থেকেই আছি। এটি একটি পরিকল্পিত অপপ্রচার।

কালবেলা: বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে ড. ইউনূসের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারণাও চলছে। আপনি কীভাবে দেখেন?
মির্জা আব্বাস: আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর এখন অনেক টাকা। তারা দেশ-বিদেশের মানুষকে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে টাকা দিয়ে পোস্ট করতে বলছে। যারা বলছে, ড. ইউনূস যেন পাঁচ বছর থাকেন—এটা হলে ড. ইউনূস এবং দেশ দুইটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে ড. ইউনূসের সম্মান ধ্বংস হবে, দেশেরও ক্ষতি হবে। যারা ইউনূসকে পাঁচ বছর রাখতে চায়, তারাই এক সময় তাকে চরম অপছন্দের ব্যক্তি বানাবে। তারা ইউনূসকে কলঙ্কিত করে ফেলবে, তার অর্জন নষ্ট করবে। কারণ, একটি অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর।

ড. ইউনূস চাইলে পাঁচ বছর, এমনকি জীবনভর থাকতে পারেন—কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে (নির্বাচনের মাধ্যমে)। তিনি যদি রাজনীতি করতে চান, করুন। প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা হন—তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু সেটা নিয়ম মেনে হতে হবে। এভাবে চলতে পারে না।

কালবেলা: তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। তিনি এখনও দেশে ফিরছেন না কেন? জিয়া পরিবারকে ঘিরে কি কোনো ষড়যন্ত্র চলছে?
মির্জা আব্বাস: তারেক রহমানের পরিবার দেশের জন্য জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। আজকের তরুণরা বলে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকেই দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু তখনকার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা থেকে দল গঠন এখনকার মতো ছিল না। জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায় ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি জনগণের হৃদয় জয় করেছিলেন। তখন থেকেই বিএনপি মানসিকভাবে গঠিত হয়ে গিয়েছিল, শুধু নাম ছিল না। জনগণের ভালোবাসা তখন থেকেই শুরু। আবার ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জীবন বাজি রেখে দেশ রক্ষা করেন। তিনি তখন কারাগারে ছিলেন, সৈনিক ও জনগণ তাকে মুক্ত করে। তিনি চাইলে নিহত হতে পারতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্য সেক্টর কমান্ডারদের মতো নয়, তার অফিস ছিল বাংলাদেশের ভেতর—সিলেটে। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যুদ্ধও করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ৭ নভেম্বর আবার জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। এরপর খালেদা জিয়া ঝুঁকি নিয়েছেন—তিনি এখনও বেঁচে আছেন, যদিও ধীরে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে (হাসিনার শাসনে) হত্যার চেষ্টা হয়েছে। জনগণ তারেক রহমানের দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছে।

কালবেলা: বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল বহু বছর ধরে হয়নি। কোনো পরিকল্পনা আছে?
মির্জা আব্বাস: আসলে জাতীয় কাউন্সিল খুবই প্রয়োজনীয়। শুধু বিএনপির মতো বড় দলের জন্য নয়, প্রতিটি দলের জন্যই নিয়মিত হওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা কাউন্সিল করতে পারিনি। তবে এর মানে এই নয় যে আমরা কাউন্সিল বাতিল করেছি। আমরা সম্প্রসারিত সভা করেছি, যা কাউন্সিলেরই অংশ বলা যায়। তবে আনুষ্ঠানিক কাউন্সিল—যেখানে নির্বাচন বা মনোনয়ন হয়—তা হয়নি। আপাতত আমরা মনে করছি, আসন্ন নির্বাচনের আগে তা অপরিহার্য নয়।

Scroll to Top