বিদেশে থেকেও গণহত্যা মামলার আসামি

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৯ জুলাই মেরুল বাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হন তৌফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া (৪৪)। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনার ১০ দিন পর, বাড্ডা থানার এসআই মো. নওশাদ আলী অজ্ঞাত প্রায় ১০ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরাই তৌফিককে গুলি করে হত্যা করেছে।

কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরিস্থিতি মোড় নেয় অন্যদিকে। ২৮ আগস্ট, নিহতের স্ত্রী ইসমত জাহান ইলোরা বাড্ডা থানায় ১১৩ জনের নাম উল্লেখ করে নতুন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন, যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি ঢাকার দুই ব্যবসায়ীর নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এজাহারে ৯৪ নম্বর আসামি করা হয় আসাদুজ্জামান হিরুকে এবং তার বাবা মো. আক্তারুজ্জামানকে ৯৫ নম্বর আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এজাহারে দাবি করা হয়েছে, আসাদুজ্জামান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের হত্যাকারীদের অর্থায়ন করতেন এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ১০০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের রক্ষক ও তার পালকপুত্র। তবে, ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতার কারণে পরিকল্পিতভাবে তাদের নাম মামলায় জড়ানো হয়েছে। তাদের দাবি, তারা কখনোই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন না বা কোনো ধরনের অর্থায়নের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না।

এজাহারে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আসাদুজ্জামানের সম্পর্ক থাকার কথা বলা হলেও, বাস্তবে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই বলে পরিবারের দাবি। একইভাবে, আক্তারুজ্জামানেরও হাসিনা সরকারের এক উপদেষ্টার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আনা হয়েছে, তবে এটিও সঠিক নয়। গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় এবং কিছু ছবি থাকার ভিত্তিতেই তাকে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে পরিবারের বক্তব্য।

প্রকৃতপক্ষে, আসাদুজ্জামান প্যারিস গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং তার বাবা আক্তারুজ্জামান বসুন্ধরা সিটির ডানহিল লন্ডন, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট-১-এর কোলন অ্যান্ড কটনের চেয়ারম্যান। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর প্রবাসে কাটিয়ে দেশে এসে ব্যবসা শুরু করেন। বাবা-ছেলের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই বলে স্বজনদের দাবি।

৫ আগস্টের পর তারা একাধিক মামলায় আসামি হন এবং আত্মগোপনে চলে যান। ১৬ জানুয়ারি গুলশান-২ এলাকা থেকে আসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

আসাদুজ্জামানের পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, তৌফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া নিহত হওয়ার সময় তিনি চীনে অবস্থান করছিলেন। মামলার নথিতে উল্লেখিত মৃত্যুর তারিখ ১৯ জুলাই, অথচ পাসপোর্ট অনুযায়ী ১৮ জুলাই তিনি চীনের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন এবং ১৯ জুলাই সেখানে পৌঁছান। ২৯ জুলাই তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

অন্যদিকে, মামলার বাদী ইসমত জাহান ইলোরা জানান, তিনি মামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না এবং পুলিশ তার বাসায় গিয়ে কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। পরে জানতে পারেন, কিছু নির্দোষ ব্যক্তির নাম এজাহারে যোগ করা হয়েছে, যা বাদ দেওয়ার জন্য তিনি হলফনামাসহ আদালতে আবেদন করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. হানিফ জানান, বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কোনো নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেননি। তদন্ত শেষে অপরাধ সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বাড্ডা থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, তদন্ত শেষে চার্জশিট চূড়ান্ত হবে এবং বাদীর বক্তব্যের কোনো গুরুত্ব নেই, কারণ মামলা একবার রেকর্ড হলে তা তদন্ত করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের মতে, এই মামলা গায়েবি মামলার নতুন উদাহরণ। আগের মতোই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেকের নাম ঢোকানো হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি মামলা বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে, যেখানে থানা পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগও উঠেছে। মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নামে বা গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও উঠেছে।

সরকার এই ধরনের মামলা বাণিজ্য বন্ধে নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে না। আইনজীবীরা আশঙ্কা করছেন, এসব মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় লাগবে এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের হয়রানির শিকার হতে হবে।

Scroll to Top