গোয়েন্দা রিপোর্ট ফাঁস: ২০১৮ সালের ভোট কারচুপির যারা ছিল আসল মাস্টারমাইন্ড

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এক বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশ-বিদেশে এটি “নীশিরাতের ভোট” নামে পরিচিতি লাভ করে। নির্বাচনের আগেই অর্ধেকের বেশি ভোট পড়ে যায়, আর ভোটের দিনে কেন্দ্রগুলোতে চলে নানা অনিয়ম—ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটারদের ওপর হামলা, জালভোট প্রদান, প্রার্থীদের গুম, ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, প্রকাশ্যে ব্যালট ছাপানো, সহিংসতা, দখলদারি ইত্যাদি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। একবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখুন। নির্বাচন কেমন সুন্দর হয় তা দেখতে পাবেন।” বিরোধী দলগুলো তাঁর কথায় আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশ নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কপালে জোটে হতাশা। নির্বাচনের পরদিন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “দেশবাসী আওয়ামী লীগের ওপর বিশ্বাস রেখেছে।” কিন্তু এর পরপরই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে—এই পরিকল্পনার নেপথ্যে কারা ছিলেন? কীভাবে আওয়ামী লীগ এমন একতরফা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারলো?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই নির্বাচনে কারচুপির পুরো পরিকল্পনা তৈরি করেছিল রাষ্ট্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এই সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা। মাঠ পর্যায়ে তা কার্যকর করতে নিয়োজিত ছিলেন সংস্থাগুলোর বিভাগীয়, মহানগর ও জেলা পর্যায়ের পরিচালক, যুগ্ম পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা।

নির্বাচনের মাঠে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ লগ্নি করা হয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুগত রাখতে এবং নির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করাতে তাদের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এমনকি নির্বাচনের আগে অনেক কর্মকর্তাকে নগদ অর্থ প্রদানের ঘটনাও উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে নিয়ে এসে প্রতারণার এই চক্রটি পুরোপুরি পূর্বপরিকল্পিত ছিল।

তদন্ত ও অনুসন্ধান

বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের সহায়তায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধান শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদেরও তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, নির্বাচনের অন্তত তিন দিন আগে থেকে সরকারি রেড ফোন ব্যবহার না করার নির্দেশনা আসে, এবং এই সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান ও তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। নির্বাচনের বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করা কিছু সামরিক কর্মকর্তাকে বিশেষভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অতীতে ছাত্রলীগে যুক্ত ছিলেন এমন কিছু কর্মকর্তাকে ডিসি-এসপিদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

নির্বাচনের আগে থেকেই অনেক পেশাদার গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে ছাত্রলীগ-সমর্থিত ও আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের বসানো হয়। নির্বাচনের সময় প্রায় ৪০-৫০ জন জেলা কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে রাখা হয়, যা নির্বাচনের পর পুনরায় স্বপদে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারচুপির নির্বাচনে জড়িত কর্মকর্তাদের পুরস্কার হিসেবে প্রাইজ পোস্টিং, বিদেশে বদলি, আর্থিক সুবিধা ও বিদেশ সফরের সুযোগ দেওয়া হয়।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচনী কারচুপির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের নাম। উদাহরণস্বরূপ, ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার একজন পরিচালক ও যুগ্ম পরিচালক। শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা জেলায় দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন উপ-পরিচালকরা।

ঢাকা বিভাগে ছিলেন পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন, অতিরিক্ত পরিচালক জামাল উদ্দিন, যুগ্ম পরিচালক ইকবাল হোসেন, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় ছিলেন একাধিক পরিচালক ও যুগ্ম পরিচালক।

ঢাকা মহানগর এলাকায় ১৭টি আসনে নির্বাচনী কারচুপির দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার এক পরিচালক (প্রশাসন), ঢাকা সিটি ইন্টারনাল অপারেশনের প্রধান কর্নেল পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা, পরিচালক শাহিন সিদ্দিকী এবং যুগ্ম পরিচালক আরিফ।

রাজশাহী বিভাগেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এখানে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা সরাসরি নির্বাচনী কারচুপির অংশ ছিলেন।

চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় যুগ্ম ও উপ-পরিচালকরা কারচুপির দায়িত্ব পালন করেন।

নির্বাচনের পরদিন একজন মহাপরিচালক, ডিডি শাহিন সিদ্দিকী ও জেডি আরিফকে নগদ অর্থ দেওয়ার তথ্যও তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাজশাহী বিভাগ, বিশেষ করে নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, রাজশাহী জেলায় নির্বাচনী কারচুপিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন নির্দিষ্ট কর্মকর্তারা।

২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল পূর্বপরিকল্পিত একটি প্রকল্প, যেখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলো ও তাদের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থাকা আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ব্যক্তিরা এই নির্বাচনী প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রাখেন। এখন বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত শুরু করলেও কারচুপির পুরো চিত্র উন্মোচিত হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।