শেখ হাসিনার রাজনীতি কি শেষ? জাতিসংঘের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারায়। ১৬ বছরের শাসনামলে গুম, খুন ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত করে প্রমাণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ও তার দলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ বিষয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ‘আগামী অক্টোবরের মধ্যে কয়েকটি মামলার রায় আসতে পারে।’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১০৮টি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি ট্রাইব্যুনালে গিয়েছে।

সরকারের এক উপদেষ্টা, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একপ্রকার ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে।

৫ আগস্টের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে, শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে এবং ঢাকায় দলটির নিষেধাজ্ঞার দাবিতে আন্দোলনও হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী। তার দল আওয়ামী লীগও একই পর্যায়ের দল।’

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়, তাদের বিচারও করতে হবে। শেখ হাসিনা ও তার দলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে, তাই অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

এদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, এখনই আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করার সময় আসেনি। তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক চর্চা সঠিকভাবে হলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। তবে নতুন সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পুরনো শক্তিগুলো আবারও সুযোগ নিতে পারে।’

বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান রিপন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার এখন লজ্জায় মুখ লুকানোর কথা। তাদের অপরাধ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, ফলে রাজনীতিতে ফেরার নৈতিক অধিকার তাদের নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার দলের একাংশ দেশের বাইরে পালিয়েছে, বাকিরা বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। তারা ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখলেও, বাস্তবে তা সম্ভব নয়।’

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ও তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও, সংস্থাটি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুপারিশ করেনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল মনে করেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সঠিক ব্যবস্থাপনা আওয়ামী লীগের জন্য ইতিবাচক হতে পারে, তবে ভুলভাবে হ্যান্ডেল করলে তা দলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পক্ষে কোনো কিছু নেই, বরং এটি প্রমাণ করে তিনি অপরাধী।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি শেখ হাসিনাকে নিয়ে এগোতে চায়, তাহলে তারা সংকটে পড়বে। তবে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্ব গঠন করলে ভবিষ্যতে ভালো অবস্থানে যেতে পারে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘জাতিসংঘ সরাসরি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সুপারিশ করেনি, তবে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যা তাদের জন্য রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে।’

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার চলছে, তারা যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ থাকবে না।’

এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।

Scroll to Top