আয়নাঘরের আলামত ধ্বংস করলো কারা?

ছোট ছোট গুমোট কক্ষ। ভৌতিক পরিবেশ। আলোহীন প্রতিটি কামরা যেন কোনো অন্ধকার কারাগার। বাইরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সময়ের কোনো ধারণা নেই, বন্দিরা জানতেই পারেন না দিন-রাতের পার্থক্য। কিছু কক্ষ আবার সাউন্ডপ্রুফ, যেখানে চলতো ভয়াবহ নির্যাতন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ভিন্নমত দমন করতে গড়ে তোলা হয়েছিল এসব গোপন বন্দিশালা, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। এখানে বছরের পর বছর বন্দি রাখা হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ নিরপরাধ অনেক মানুষকে। কেউ কেউ ফিরে এসেছেন, আবার কেউ নিখোঁজই রয়ে গেছেন। অনেকের শেষ গন্তব্য হয়েছে মৃত্যু। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুম হওয়া ব্যক্তিদের এখানে আটকে রাখত, তাদের ওপর চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। আয়নাঘরের দেয়ালে বন্দিদের জীবনযাত্রার ছাপ এখন ইতিহাসের সাক্ষী। তবে, সেই ইতিহাসের অনেকটাই এখন মুছে ফেলা হয়েছে।

গতকাল রাজধানীতে থাকা তিনটি আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কচুক্ষেত, আগারগাঁও ও উত্তরায় অবস্থিত এসব আয়নাঘরের মধ্যে একটি ডিজিএফআই’র, বাকি দু’টি র‌্যাবের নিয়ন্ত্রণে ছিল। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তারা, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা এবং গুম কমিশনের সদস্যরা। কিন্তু সরকার আগের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুমতি দেয়ার কথা থাকলেও, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দুটি গণমাধ্যম—আলজাজিরা ও নেত্র নিউজ—এ সুযোগ পেয়েছে। একমাত্র একজন সংবাদকর্মী পুরো পরিদর্শন পর্যায়ে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজে আয়নাঘরের অভ্যন্তরের দৃশ্য উঠে এসেছে। একেকটি ফুটেজ যেন নির্যাতনের ভয়াবহ স্মৃতি বহন করছে। তবে, ফুটেজ প্রকাশের পরই আলামত ধ্বংসের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। দেখা গেছে, অসংখ্য কক্ষের দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে, নতুন রং ও পলেস্তারা দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে বন্দিদের লেখা কথাগুলো। তাদের আর্তনাদ ও গল্প খোদাই করা ছিল দেয়ালে, যা এখন আর দৃশ্যমান নেই। নির্যাতনে ব্যবহৃত বহু সরঞ্জামও সরিয়ে ফেলা হয়েছে, আর যেগুলো এখনো আছে, সেগুলো অকেজো করে রাখা হয়েছে। আয়নাঘরে ছিল ইলেকট্রিক চেয়ার, উচ্চ শব্দ তৈরির যন্ত্র এবং নানা বৈদ্যুতিক নির্যাতন সরঞ্জাম। পুরো জায়গাটি ছিল সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে, তবে এখন ক্যামেরার বেশিরভাগ ফুটেজই উধাও। দেয়াল ভেঙে নির্যাতনের ইতিহাস মুছে ফেলা হয়েছে।

এতসব আলামত ধ্বংসের কারণ কী? কারা এ নির্দেশ দিয়েছে? আদৌ কি এর জবাব পাওয়া যাবে? গুম কমিশনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। কমিশনের সভাপতি, হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলামত ওয়ালে পেইন্ট করে নষ্ট করা হয়েছে। ভিক্টিমরা বলেছিলেন, দেয়ালে তারা তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে রাখতেন। কিন্তু সেগুলো এখন আর নেই।’ তিনি আরও জানান, ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পরপরই এসব আলামত মুছে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে আলামত ধ্বংস নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখছে গুম কমিশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররা মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। সরকার প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখছে এবং আয়নাঘরগুলো আলামত হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে।

আয়নাঘরের ভয়াবহ চিত্র

আয়নাঘরের ভেতরের চিত্র ছিল ভয়ংকর। ছোট ছোট খুপরি ঘর, অধিকাংশ তিন ফুট বাই চার ফুট আয়তনের, যেখানে একজন বন্দির নড়াচড়া করার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল না। কিছু কক্ষে ছিল ছোট হাওয়া চলাচলের জন্য লাগানো ফ্যান, কিছু ক্ষেত্রে দুটি ভেন্টিলেটর, যেখান দিয়ে সামান্য বাতাস আসতো। কিন্তু একই কক্ষেই বন্দিদের প্রস্রাব-পায়খানা সারতে হতো। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বন্দিদের এমন অমানবিক পরিস্থিতিতে রাখা হতো।

সবসময় এগজস্ট ফ্যান চালু থাকতো, আর যখনই ফ্যান বন্ধ করা হতো, তখন কান্না ও গোঙানির শব্দ শোনা যেতো। বন্দিদের হাতকড়া পরিয়ে, চোখ-মুখ কাপড়ে বেঁধে রাখা হতো। কেবল খাবার ও বাথরুম ব্যবহারের সময় হাত খোলা হতো। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব গোপন কারাগার পরিদর্শন করে হতবাক হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার যে বর্বরতা চালিয়েছে, এটি তারই একটি নমুনা।’ তার বক্তব্যের থেকেও ভয়ংকর চিত্র দেখা গেছে আয়নাঘর পরিদর্শনে।

র‌্যাব-১, র‌্যাব-২ ও ডিজিএফআই-এর প্রধান কার্যালয়ে থাকা আয়নাঘরগুলো পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, সরকারের দায়িত্ব হবে এসব গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব ও এখানে সংঘটিত অপরাধের যথাযথ তদন্ত নিশ্চিত করা। বন্দিরা কীভাবে দিন কাটাতো, তারা কীভাবে সংকেত দিয়ে তাদের দুর্ভোগ লিপিবদ্ধ করতো—তার কিছু অংশ এখনো আয়নাঘরের দেয়ালে পাওয়া যায়। তবে, এর অনেকটাই মুছে ফেলা হয়েছে।

প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—এই আলামত ধ্বংসের পেছনে কারা রয়েছে? এর পেছনের ষড়যন্ত্র কী? আদৌ কি এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে?

Scroll to Top