আওয়ামী লীগে ভাঙ্গনের সুর, আসছে হাসিনার বিকল্প কেউ?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পর দলটি এক গভীর সংকটে পড়েছে। দলটির ভেতরে চলছে তীব্র বিভক্তি এবং নেতৃত্বের সংকট। আগামীতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে? নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে নতুন কোনো মুখ আসবে কি না, তা নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

২০২৪ সালের ১ জুলাই রংপুরে এক ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। এটি ছিল আওয়ামী লীগের জন্য এক কঠিন সময়ের সূচনা। যখন আন্দোলন চরমে পৌঁছায়, তখন দলের উচ্চপর্যায়ের নেতারা এটিকে গুরুত্ব দেননি। বরং তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হয় এক গণ-অভ্যুত্থান। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ নিহত হন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকারবিরোধী আন্দোলনে কমপক্ষে ৮৩৪ জন প্রাণ হারান, আহত হন ২০,০০০ এরও বেশি মানুষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান। তার এই নাটকীয় প্রস্থান দেশের জনগণের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

আওয়ামী লীগের নেতারা দলটির এই বিপর্যয়ের জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল সমস্যা ছিল নেতৃত্বের ব্যর্থতা, গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব এবং জনগণের আস্থা হারানো। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে দলটি একটি স্বৈরাচারী কাঠামোর দিকে ধাবিত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল এককেন্দ্রিক, এবং স্থানীয় নেতাদের মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন। খুলনার এক ছাত্রলীগ নেতা জানান, তিনি দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় থাকলেও, আন্দোলনের সময় তার সিনিয়র নেতাদের খুঁজে পাননি। দলের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে তিনি রাজনীতি থেকে সরে গেছেন।

আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন অনেক আলোচনা চলছে। দলে কি শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা উঠে আসবে? নতুন নেতৃত্ব কি পারবে দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে?

কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ভুল স্বীকার করে এবং দলে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনে, তাহলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব সংকট এবং তৃণমূলের আস্থা হারানোর ফলে এটি কঠিন হয়ে পড়বে।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সংগঠনগুলোর মধ্যেও এখন অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং কৃষক লীগের অনেক সদস্যই দলীয় নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। দলটি কি নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, নাকি ধীরে ধীরে ভেঙে যাবে? সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

শেখ হাসিনার শাসনামলের পর দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নতুন নেতৃত্ব কে হতে পারেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। কিছু নাম উঠে আসছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হলে তরুণ এবং উদারপন্থী নেতাদের সামনে নিয়ে আসতে হবে।

আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি করেছেন, দলটি সেনাবাহিনী এবং ইসলামপন্থীদের যৌথ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তবে তিনি এই অভিযোগের পক্ষে কোনো শক্তিশালী প্রমাণ দিতে পারেননি। দলের অনেক নেতার মতে, ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীভূত থাকার কারণে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। জনগণের দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়াই তাদের পতনের অন্যতম কারণ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগের নতুন নেতা কে হতে পারেন? অনেকে বলছেন, তরুণ প্রজন্মের নেতাদের সুযোগ দেওয়া উচিত। তবে দলটির বর্তমান অবস্থা বলছে, নতুন নেতৃত্ব গঠনের জন্য আওয়ামী লীগকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি আপাতত ভারতে অবস্থান করছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার পুনঃপ্রবেশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদি আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে আবার শক্তিশালী হতে চায়, তাহলে তাদের অবশ্যই নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। নেতৃত্বের সংকট, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং জনগণের আস্থা হারানো দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আওয়ামী লীগ নিজেদের ভুল স্বীকার করে এবং দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে পারে, তাহলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, দলের জন্য আগামী সময়টা খুব একটা সহজ হবে না।

Scroll to Top