আওয়ামী লীগের কর্মসূচি, কঠোর অবস্থানে সরকার

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘদিন নীরব থাকা আওয়ামী লীগ নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে, যার মধ্যে রয়েছে হরতাল, বিক্ষোভ ও অবরোধ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। সরকারের তরফ থেকে আরও বলা হয়েছে, জনগণই তাদের প্রতিহত করবে।

দলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ১ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লিফলেট বিতরণ করা হবে, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, ১০ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের পরিকল্পনা রয়েছে, ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হবে। তবে এর আগে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটির কোনো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম দেখা যায়নি। দলের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, কেউ কেউ পলাতক রয়েছেন, আর কয়েকজন নেতা কারাগারে আটক আছেন।

গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকেই সেখানেই অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, হত্যা, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। চলমান মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় তাকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার গত ২৩ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য ভারত সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ যতদিন না গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চায় এবং বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসে, ততদিন তাদের কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সরকারের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই গত জুলাই মাসের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এত বড় একটি হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগ অনুশোচনা না করে বরং মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে, যা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

ওদিকে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ঘোষণার পর বিএনপি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, এতগুলো মানুষ হত্যার পর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা অনুশোচনাহীন এক নেত্রীর আর্তচিৎকার ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের হত্যা করেছে এবং পুরস্কারের আশায় এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই, বরং তিনি দেশে ফেরার সুযোগ পেলে দেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রধান সংগঠক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, এত মানুষ হত্যা করার পরও শেখ হাসিনা কীভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করেন? রাজধানীর কাকরাইলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে আয়োজিত একটি প্রদর্শনী পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বড় হত্যাযজ্ঞের পরও যদি কোনো অপরাধী প্রকাশ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে, তাহলে সেটি দেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক বিষয়।

এর আগে ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগ রাজপথে নামার ঘোষণা দিলেও দলটির কোনো নেতা-কর্মীকে কার্যকর কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগও ফেব্রুয়ারি মাসে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগের এসব কর্মসূচি কতটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।


কারাগারে বসেই ঝাড়ফুঁক দিচ্ছেন দরবেশ

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন যে, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সমন্বয়ে দেশে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি পাশের দেশ থেকে কর্মসূচির ঘোষণা দিচ্ছেন, আর জেলখানায় আটক থাকা কয়েকজন ব্যক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। এর মধ্যে অন্যতম সালমান এফ রহমান, যাকে রিজভী ‘দরবেশ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি কারাগার থেকেই ‘ঝাড়ফুঁক’ দিচ্ছেন।

বুধবার রাজধানীর রমনায় ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) সেমিনার হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রিজভী এসব মন্তব্য করেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (এ্যাব) এ আয়োজন করে।

রিজভী বলেন, “তিনি (সালমান এফ রহমান) মাঝেমধ্যে কারাগার থেকে ‘ঝাড়ফুঁক’ পাঠাচ্ছেন। অথচ তার নির্দেশে হাজারো শ্রমিক রাস্তায় নেমে যাচ্ছে! আমি জানি না, তাদের বিচার প্রক্রিয়া কীভাবে চলছে, কীভাবে তারা বাইরে থেকে এসব কথা বলছে?”

তিনি আরও বলেন, “নিশ্চয়ই তাদের বিশেষভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যা তারা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।”

বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, “আমাদেরকে কারাগারে মাদকসেবী ও ফাঁসির আসামিদের সঙ্গে রাখা হতো। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে গুম, খুন ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।”

সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আপনারা সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করবেন না। এমন সংস্কার আনুন, যাতে ফ্যাসিবাদের পুনর্জন্ম না হয় এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায়।”

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের অবদানের কথা তুলে ধরে রিজভী বলেন, “জিয়াউর রহমান শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক নন, তিনি বহুমুখী নেতৃত্বের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অসামান্য। আওয়ামী লীগ সরকার তার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করলেও, জনগণ তাকে মনে রেখেছে।”

তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে ১৫ আগস্টের ঘটনা ঘটেছিল। অথচ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।”

রিজভী অভিযোগ করেন, “শেখ হাসিনা জবরদস্তি করে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার পরিবারের নামে দেশের বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে। এটি কোনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়, বরং একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ।”

এই বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি নেতা রিজভী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, কারাগারে বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং বিরোধী দলের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।