‘দরবেশ’ একাই লুটেছেন ৫৭ হাজার কোটি টাকা: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র

গত দেড় দশকে ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি সালমান এফ রহমান। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি নিজের নামে ও বেনামে মোট ১৮৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

তথ্য অনুসারে, সালমান এফ রহমান ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং পুঁজিবাজার থেকে আরও ৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংক থেকে নেওয়া এই ঋণের মধ্যে ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। শুধু নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই নয়, তিনি বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলেও এই অর্থ লুট করেছেন।

আর্থিক খাতে সালমান এফ রহমানের একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তার প্রভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এই ব্যাংক থেকেই তিনি লুট করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী, আইএফআইসি, রূপালী, ন্যাশনাল ও এবি ব্যাংক থেকে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক ও বিমাসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুট করা হয়েছে। সালমান শুধু ব্যাংক লুটেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি শেয়ারবাজারে কারসাজি করার জন্য সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও ব্যবহার করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, কিন্তু সেগুলো দেখা যাচ্ছে না।”

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সালমানের ২৯টি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা এখন খেলাপি।

এই ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। প্রথমে টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে, পরে কাগজপত্র তৈরি করে তা ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সালমান এফ রহমান পুঁজিবাজারের অন্যতম কারসাজির হোতা। গত তিন দশকে তার কারসাজির কারণে অসংখ্য বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তিনি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ব্যক্তি এবং বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনে বাজারে কারসাজি করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সালমান এবং তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানসহ ৭৪ ব্যক্তি এবং বেনামি আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে। এসব শেয়ার সাতটি ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে কেনা হয়।

আইএফআইসি ব্যাংক:
সালমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২৯টি বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঋণ নেওয়া হয়।

সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক:
এই তিন ব্যাংক থেকে তিনি ৩ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যার বেশিরভাগই খেলাপি।

ন্যাশনাল ব্যাংক:
৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নেওয়া ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা খেলাপি।

এবি ব্যাংক:
এবি ব্যাংক থেকে সালমানের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অনিয়মের তদন্ত শুরু করেছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটের ঘটনায় সালমান এফ রহমান ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সালমান বর্তমানে জেলে থাকায় তার বক্তব্যও নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এই বিশাল লুটপাটের ঘটনায় অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, এই অনিয়মের সমাধানে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আর্থিক খাতের অবস্থা আরও বিপর্যস্ত হবে।


ভারতে পালিয়ে যাচ্ছেন দুর্নীতি ও গণহত্যা মামলার আসামিরা,প্রতিবেদনে উঠে এলো চঞ্চল্যকর সব তখ্য

বাংলাদেশে দুর্নীতি এবং গণহত্যার সাথে জড়িত একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বিভিন্ন সময় পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তার পলায়নের খবর উঠে আসছে, যা দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, শাসক দলের সদস্যরা গণ-অভ্যুত্থান এবং দুর্নীতির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দেশত্যাগের পথ বেছে নিচ্ছেন। পালিয়ে যাওয়ার কৌশল এবং বিভিন্ন দেশের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান গোপন করতে সক্ষম হচ্ছেন।

দুর্নীতিবাজ ও গণহত্যা মামলার আসামিরা পালাচ্ছেন এবং তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ইনকিলাবের করা একটি প্রতিবেদন থেকে নিচে বিস্তারিত হুবহু তুলে ধরার হলো:-

৫ আগস্টের পর পলায়নরত কয়েকজন ধরা পড়েছেন। পলায়নকারীদের ‘নিজস্ব কৌশল’ সে ক্ষেত্রে মার খেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি সাধারণ মানুষের চোখেও তারা ধুলো দিতে পারেননি। ধরা পড়েছেন শেখ হাসিনাকে আইনি মন্ত্রণাদানকারী আনিসুল হক, এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জুনাইদ আহমেদ পলক, শ্যামল দত্ত, মোজাম্মেল বাবুরা। ‘পালাব না’ বলে কয়েক মাস ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে ছিলেন। পরে মওকা বুঝে ফুরুত করে পালিয়ে যান ওবায়দুল কাদেরও।

পালিয়ে গেছেন হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, গোয়েবলস মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, ‘মাস্তান আমলা’-খ্যাত কবির বিন আনোয়ার, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসিনার এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবুর মতো শত শত এমপি। এদের অনেকের এখন দেখা মিলছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, নয়াদিল্লি, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে। এক এক করে প্রকাশিত হচ্ছে তাদের পালিয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প। যা পূর্ব আফ্রিকার পটভূমিতে রচিত এডগার রাইজ বারোজের কাল্পনিক চরিত্র ‘টারজান’কেও হার মানায়।

‘পালিয়ে যাওয়া’দের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। আর এ তালিকার সর্বশেষ সংযোজন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। গত ২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার তিনি দেশ ছাড়েন। ওই দিন শেরপুরের নালিতাবাড়ী হয়ে সন্ধ্যায় হালুয়াঘাট সীমান্ত অতিক্রম করেন। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সাউথগারো হিলসের সরুপথ বেয়ে মিশে যান মেঘালয়ের লোকালয়ে।

জামালপুর-৩ আসন থেকে আওয়ামী টিকিটে তিনি ছয়বার এমপি নির্বাচিত হন। সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে একাধিক হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া মির্জা আজম, স্ত্রী দেওয়ান আলেয়া ও কন্যা মির্জা আফিয়া আজম অপির বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা। তিনি ও তার পরিবার এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৬০টি অ্যাকাউন্টে ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। গত ১২ ডিসেম্বর মামলাটি দায়ের করে দুদক।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, মির্জা আজম গোয়েন্দা নজরদারিতেই ছিলেন। তার ও পরিবারের সদস্যদের ফোন ট্র্যাকিংয়ে ছিল। কিন্তু পুরোনা কোনো ফোন নম্বর ব্যবহার না করায় তার গতিবিধি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করার পর সংস্থাটির তদন্ত টিম মির্জা আজমের মাদারগঞ্জ উপজেলার সুখনগরী গ্রামে অন্তত তিনবার হানা দেয়। কিন্তু গ্রামের ঠিকানায় তার টিকিটির সন্ধান মেলেনি।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টের পর নির্বাচনী এলাকায়ই যাননি মির্জা আজম। কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করে দেশের ভেতরই আত্মগোপনে ছিলেন পাঁচ মাস। ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারণা করছে, তিনি বৈধ পথে দেশত্যাগ করতে পারবেন না।

হাসিনা সরকারের হুইপ ইকবালুর রহিমের বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত তিনটি হত্যা মামলা। দিনাজপুর উপজেলার ৩ নং ফাজিলপুর বিদুরসাহী গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের পুত্র রবিউল ইসলাম রাহুলকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট ও ২০ আগস্ট ইকবালুর রহিমসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা হয় গত ১১ ডিসেম্বর।

এছাড়া ৮৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইকবালুর রহিম ও তার স্ত্রী নাদিরা সুলতানার বিরুদ্ধে গতকাল বুধবার মামলার অনুমোদন দেয় দুদক।

৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দিনাজপুর-৩ আসনের আওয়ামী এমপি ইকবালুর রহিমের দক্ষিণপুর মুন্সিবাড়ির বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পর থেকে তাকে ঢাকা কিংবা দিনাজপুর কোথাও জনসম্মুখে দেখা যায়নি। তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল হলেও ২৭ নভেম্বর তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর আগে চার মাস তিনি ঢাকার দুই নিকটাত্মীয়ের বাসায় পর্যায়ক্রমে আত্মগোপনে ছিলেন।

নওগাঁ-৩ আসনে হাসিনার ‘ডামি নির্বাচন’-এর এমপি সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তীকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি অভ্যুত্থানের পর। দেড় মাস আত্মগোপনে থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি দেশ ছাড়েন বলে জানা যায়।
একাধিক হত্যা মামলার আসামি কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক। একাধারে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের পুত্র। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কিশোরগঞ্জ গ্রামের বাড়িতে আগুনে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। ৪ আগস্ট কিশোরগঞ্জ গৌরাঙ্গবাজার এলাকায় মো. সুজন মিয়া নামের এক তরুণ আইনজীবীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ৯ সেপ্টেম্বর মামলা হয়। মামলা রুজুর আগ পর্যন্ত তারা ক্যান্টনমেন্টেই ছিলেন। সেখান থেকে আত্মগোপনে চলে যান আব্দুল হামিদ, পুত্র রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক ও তার ছোট ভাই যুবলীগ নেতা রাসেল আহমেদ তুহিন। ১৯ আগস্টে পিতা এবং দুই পুত্র আলাদাভাবে দেশ ছাড়েন। তৌফিক ও তুহিনের বিরুদ্ধে দুদকে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান।

সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও রাজবাড়ী-২ আসনের আওয়ামী এমপি জিল্লুল হাকিমের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যাচেষ্টা মামলা। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৩১ আগস্ট জিল্লুল হাকিম, তার পুত্র মিতুল হাকিমসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয় বালিয়াকান্দি থানায়। তিনিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে। একটি মামলায় জিল্লুল হাকিমের চাচাতো ভাই এহসানুল হাকিমকে গ্রেফতার করা হলেও জিল্লুলের হদিস মিলছে না কোথাও।

১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী থেকে আওয়ামী টিকিটে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন জিল্লুল হাকিম। তার বিরুদ্ধে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে দুদকে। দুর্নীতিবাজ এই আওয়ামী নেতাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগেরই এক প্রবাসী নেতা।

সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক জিন্নাতুল ইসলাম মো. জিল্লুল হাকিম, তার স্ত্রী সাইদা হাকিম এবং পুত্র আশিক মাহমুদ মিতুলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। তবে এর আগেই তিনি ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ উত্তোলন করেন। পরবর্তীতে দেশত্যাগ করেন।

শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। সর্বশেষ হাসিনার ডামি নির্বাচনে তিনি চাঁদপুর-১ আসন থেকে এমপি হন। তিনি দেশ ত্যাগ করেন নভেম্বরে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণের নির্দেশদাতা ছিলেন ডা. দীপু মণি ও সেলিম মাহমুদ। এ ঘটনায় এ দুজনসহ ৬২৪ জনকে আসামি করে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলা হয়। গণহত্যার অভিযোগে গত ২১ আগস্ট বারিধারার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় ডা. দীপু মণিকে। পরে তাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। কিন্তু অধরা থেকে যান ড. সেলিম মাহমুদ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হন তিনি। তার বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান করলেও দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞার কথা জানা যায়নি। ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট বাতিল হলেও হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান সেলিম মাহমুদ। বর্তমানে তিনি সস্ত্রীক লন্ডন রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে কুমিল্লার শহীদনগরে শাহাদাত বরণ করে স্কুলছাত্র রিফাত। এ ঘটনায় রিফাতের মা নিপা আক্তার বাদি হয়ে মামলা করেন গত ১ সেপ্টেম্বর। এ মামলায় কুমিল্লা-১ এর সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুরসহ আসামি করা হয় ৫৫ জনকে। এ মামলায় আ.লীগ নেতা ও দাউদকান্দি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী সুমনকেও আসামি করা হয়। তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করছে। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী সুমন এখন পর্যন্ত দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে দেশ ছেড়েছেন ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর। গত ডিসেম্বরে তাকে সপরিবারে মালয়েশিয়ায় দেখা গেছে।

৫ আগস্টের পর দেশের কোথাও জনসম্মুখে দেখা মেলেনি ঢাকা-৫ আসনের সাবেক এমপি মশিউর রহমান মোল্লা সজল, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি জাহিদ আহসান রাসেল, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানমকে। এদের মধ্যে সজল ও নজরুল ইসলাম বাবু পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে গেছেন বলে জানা গেছে। পালানোর সময়-সুযোগের অপেক্ষায় দেশের ভেতরই আত্মগোপনে রয়েছেন হাসিনা আমলে বিভিন্ন সময় ‘নির্বাচিত’ অন্তত আড়াইশ’ এমপি। তারা চুল-দাড়ি রেখে, বোরকা পরে ছদ্মবেশে দেশে চলাফেরা করছেন। একই সঙ্গে পালানোর পথ-পদ্ধতি খুঁজছেন।

গোয়েন্দা সূত্রটি আরো জানায়, পলায়নপর আওয়ামী নেতা, এমপি-মন্ত্রীরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন। শেখ হাসিনাসহ তার দোসর, সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু বেআইনি হলেও অনেকের হাতে রয়েছে সাধারণ পাসপোর্ট। এসব পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশত্যাগ করছেন কেউ কেউ। তবে অধিকাংশই দেশত্যাগ করছেন প্রচলিত আন্তর্জাতিক রুট পরিহার করে। বেশির ভাগই দেশত্যাগ করছেন ভারত হয়ে। ভারত এবং বাংলাদেশি দালালচক্রের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করছেন অনেকে। এ প্রক্রিয়ায় নিরাপদ সীমান্ত অতিক্রমে খরচ করছেন পাঁচ থেকে ২০ লাখ টাকা। তবে সম্প্রতি বিজিবির সক্রিয়তায় সীমান্ত পথ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই দালালচক্র আবিষ্কার করে নিয়েছে পলায়নে সহযোগিতার নতুন পথ। আর সেটি হচ্ছে নৌ-পথ। যদিও এ পথের যাত্রা অত্যন্ত দুঃসাহসিক। পলায়নপর অপরাধীরা এ রুটে প্রথমে যাচ্ছেন টেকনাফের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত শাহ পরীর দ্বীপে। সাবরাং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এই দ্বীপ থেকে মাছ শিকারের ট্রলারে উঠছেন তারা। এখান থেকে সমুদ্রপথে গিয়ে ভিড়ছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর কাকদ্বীপ মৎস্যবন্দর, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, শঙ্করপুর কিংবা পেটুয়াঘাট মৎস্যবন্দরে।

এদিকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট বাতিল করা সত্ত্বেও অনেক আসামি পালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থা ওয়াকিবহাল কি-না জানতে চাওয়া হয় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে। জবাবে গতকাল বুধবার তিনি বলেন, অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টির প্রতি আমরা কনসার্ন। এ বিষয়ে আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সরকারও সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে পলায়ন রোধের। দায়িত্বটি রাষ্ট্রের। গণহত্যাকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্গান কাজ করছে।

দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেক দুর্নীতিবাজ পালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে দুদকের বিশেষ কোনো উদ্যোগ কিংবা নজরদারি আছে কি-না জানতে চাওয়া হয় দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আকতার হোসেনের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত ও অনুসন্ধানাধীন অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে আদালতের অনুমোদনক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্তদের মধ্যে কেউ পালিয়ে গেছেন মর্মে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। সুনির্দিষ্ট কারো বিষয়ে তথ্য থাকলে সেটি কমিশনের কাছ থেকে অবহিত হয়ে জানাতে হবে।