সমন্বয়কদের তদবির বাণিজ্য: এক রাফির হিসাবেই ৩২ কোটি টাকা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র খান তালাত মাহমুদ রাফি একসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিত হন। মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে কোটার সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া রাফি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হন। পরবর্তীতে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক নির্বাচিত হন। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা তদবির বাণিজ্য, অর্থ লেনদেন, এবং দুর্নীতির অভিযোগ তার এই পরিচিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

রাফির বিকাশ অ্যাকাউন্টে ১ আগস্ট থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬১ লাখ টাকার লেনদেন হয়, যা একটি সাধারণ ছাত্রের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক। এই অ্যাকাউন্টটি তার নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে খোলা। এছাড়াও, মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে খোলা আরেকটি বিকাশ অ্যাকাউন্টে একই সময়ের মধ্যে ৩১ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। দুই অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা ১৬৪ কোটি টাকার পণ্য খালাসে তদবির করেন রাফি। ২ সেপ্টেম্বর বন্দরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের আগে হোটেল সেন্টমার্টিনে গোপন মিটিং করেন তিনি। এই মিটিংয়ে বন্দরভিত্তিক ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। ব্যবসায়িক স্বার্থে রাফি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখেন।

রাফির নাম এসেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের বদলি এবং বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারে তদবিরের অভিযোগেও। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উপবিভাগের প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশকে বরখাস্ত থাকা অবস্থায় রংপুরে বদলি করার ঘটনায় রাফির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নিয়মবহির্ভূত এবং প্রশ্নবিদ্ধ।

রাফির বাইনেন্স অ্যাকাউন্টে ২৬ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩২ কোটি টাকা) জমা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তার এনআইডি দিয়ে খোলা এই অ্যাকাউন্টে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তানি এবং আমেরিকান নাগরিকদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা বিব্রত।

গত দুই মাসে রাফি কক্সবাজারে একাধিকবার গিয়ে গোপন বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। ৭ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে তার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে।

রাফি তার পরিচিতি এবং অবস্থান ব্যবহার করে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তবে তার ব্যক্তিগত কার্যকলাপ এবং আর্থিক লেনদেন আন্দোলনের স্বচ্ছতা এবং নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অনেক শিক্ষার্থী এবং সমন্বয়ক রাফির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হৃদয় তনুয়া হত্যা মামলার তদন্তেও রাফির নাম আসায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

একসময় যে রাফি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তার পুরো কার্যক্রমকে বিতর্কিত করে তুলেছে। তদবির বাণিজ্য এবং অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে, এটি কেবল তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির ক্ষতিই করবে না, বরং একটি ন্যায্য আন্দোলনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে যে নেতৃত্ব কেবল জনপ্রিয়তা নয়, বরং নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে স্থায়ী হয়।


কীভাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীর অপহরণ বদলে দিল বাংলাদেশের ইতিহাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম (বীর বিক্রম) এবং তার স্ত্রী নিম্মিকে অপহরণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা। ঘটনাটি ১৯৭৪ সালের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সংঘটিত হয় এবং এর প্রভাব পরে দেশের রাজনীতি এবং সামরিক অঙ্গনে।

১৯৭৪ সালে ঢাকা লেডিস ক্লাবে কর্নেল রেজার বিয়ের অনুষ্ঠানে মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রী নিম্মি উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানের আয়োজনে মূল ভূমিকা পালন করছিলেন ডালিম ও তার স্ত্রী। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে, গাজী গোলাম মোস্তফা এবং তার ছেলেদের সঙ্গে ডালিমের শালার (বাপ্পি) সঙ্গে এক উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

ডালিমের শালা বাপ্পি, যিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ছাত্র, ছেলেদের বসার জায়গায় বসেছিলেন। সেই সময় মোস্তফার ছেলেরা বাপ্পির চুল নিয়ে বিদ্রূপ করে এবং তা নিয়ে টানাটানি করে। প্রথমবার বাপ্পি এটি সহ্য করলেও, দ্বিতীয়বার তিনি প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা তীব্র আকার ধারণ করে।

বিয়ের অনুষ্ঠানের উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে, রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা রেড ক্রিসেন্টের লোগোযুক্ত দুটি মাইক্রোবাস এবং এক গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তার সঙ্গে সশস্ত্র ব্যক্তিদের একটি দল ছিল। মোস্তফা গাড়ি থেকে নেমেই চিৎকার করতে থাকেন, “মেজর ডালিম কোথায়?” এরপর তিনি মেজর ডালিম, তার স্ত্রী নিম্মি, এবং অন্যান্য কয়েকজনকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যান।

ডালিমের পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে এই অপহরণের খবর পৌঁছালে তারা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। ডালিমের ছোট ভাই স্বপন দ্রুত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে ঘটনাটি জানান। সারা শহরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট বসানো হয়, এবং অপহৃতদের খোঁজে অভিযান শুরু হয়।

এদিকে, অপহরণের পর ডালিম এবং তার স্ত্রীসহ অন্যান্যদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। অপহরণের খবরে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, এবং সেনাবাহিনীর চাপে গাজী গোলাম মোস্তফা অপহৃতদের মুক্তি দিতে বাধ্য হন। পরে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে একটি সমঝোতা হয়, যেখানে মোস্তফা মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রী নিম্মির কাছে ক্ষমা চান।

গাজী গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি বিদেশি সাহায্যের মাধ্যমে পাঠানো কম্বল এবং শিশু খাদ্যের টিন বিক্রি করে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই ত্রাণ সামগ্রী, যা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য পাঠানো হয়েছিল, তার একটি বড় অংশ ভারতে পাচার করা হয়।

এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য পাঠানো কম্বলও আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। সাতটি শিশুখাদ্যের টিনের মধ্যে মাত্র একটি এবং ১৩টি কম্বলের মধ্যে মাত্র একটি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে পৌঁছেছিল বলে জানা যায়।

গাজী গোলাম মোস্তফা আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি তার প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন।

তবে তার বিতর্কিত কার্যক্রম এবং অপহরণের ঘটনায় তার রাজনৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশাসনের পতনের পর মোস্তফার অবস্থা আরও খারাপ হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং প্রশাসনের পতনের পর গাজী গোলাম মোস্তফা দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন। তিনি বিপুল অর্থ নিয়ে স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে পথচারীদের হাতে ধরা পড়ে তিনি কারাগারে পাঠানো হন।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯৮০ সালে তিনি মুক্তি পান। পরে মোস্তফা তার পরিবারের সঙ্গে ভারত ভ্রমণ করেন।

১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি, তিনি মুইন আল-দীন চিশতির মাজারে যাওয়ার পথে তার গাড়ির সঙ্গে একটি ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় মোস্তফা এবং তার পরিবারের সবাই নিহত হন।

মেজর ডালিমের স্ত্রীকে অপহরণের ঘটনা শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত ঘটনার সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি জটিল অধ্যায়ের প্রতিফলন। গাজী গোলাম মোস্তফার এই কার্যকলাপ তার রাজনৈতিক জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিতর্ক তাকে তাড়া করেছে, এবং তার মৃত্যু দুর্ঘটনার মাধ্যমে একটি বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে।

এই ঘটনা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে থাকবে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামরিক পটভূমির জটিলতাকে আরও গভীরভাবে বোঝার সুযোগ করে দেয়।