বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিজয় গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা দেশকে আরও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিরোধীরা একে ‘ভুয়া নির্বাচন’ আখ্যা দিয়ে বয়কটের ডাক দিয়েছে। বিরোধী দল নির্বাচনের দিনে বাড়িতে থাকার জন্য বললে, জনগণ তাদের আবেদনে সাড়া দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। রোববারের নির্বাচনে শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২২টিতে জয়লাভ করে। বাকি আসনগুলোর অধিকাংশই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছে, যাদেরকে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল ‘ডামি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পর মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। দলটির দাবি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানান। তবে সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি এর আগে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন, সেই সময়ে বাংলাদেশ একই সাথে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈষম্য দেখেছে।
সমালোচকদের মতে এই সময়কালকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
ঢাকা জুড়ে রোববার ভোটকেন্দ্রগুলিতে ভোটারদের উৎসাহের অভাব দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের ব্যাজ পরা ক্ষমতাসীন দলের অনুগতদের দিয়ে ভোটারের সারিগুলোকে দীর্ঘ করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বস্তি এলাকার এক মধ্যবয়সী নারী জানান, তাকে সারাদিন ভোট কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ৫০০ টাকা (৪.৫০ মার্কিন ডলার) এবং একটি বিরিয়ানির প্যাকেট দেয়া হয়। এরমধ্য দিয়ে একটি ‘ব্যস্ত নির্বাচনের’ ভ্রম তৈরির চেষ্টা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই প্রহসনমূলক নির্বাচনে ভোটারদের হতাশাজনক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, এদেশের মানুষ বর্তমান ও আসন্ন সরকারের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি আমাদের দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিএনপির অহিংস আন্দোলনের পক্ষে একটি বড় বিজয়।
পঞ্চম মেয়াদে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় বসা নিয়ে ব্যাপক হতাশা দেখা গেছে। বিশেষ করে অল্পবয়সী ও শহুরে ভোটারদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। ৩৩ বছর বয়সী কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম হক বলেন, আমার এই প্রহসনে অংশ নেয়ার কোনো আগ্রহ নেই। এটি আওয়ামী লীগের নতুন নাটক।
সজিব উজ জামান নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, এই নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের আসল স্বাদ নেই। ২৬ বছর বয়সী এই লেখক, যিনি একটি স্থানীয় ম্যাগাজিনের জন্য কাজ করেন, তিনি বলেছেন যে বাক স্বাধীনতা এবং ভিন্নমতের সুরক্ষা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হ্রাস পেয়েছে। আমি নিজেই শুধুমাত্র অল্প কয়েক জনের সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশ করতে পারি, কারণ তাদেরকে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। এই সতর্কতার কারণ হল আমি যদি প্রকাশ্যে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলি, তাহলে আমি আইনি পদক্ষেপ বা শারীরিক হামলার ঝুঁকি নিয়ে থাকি।
শেখ হাসিনা সোমবার তার বিজয়ের পর সাধারণ নির্বাচনের সমালোচনাকে “অবৈধ” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। যারা সমালোচনা করতে চান তারা সমালোচনা করতে পারেন।
আওয়ামী লীগের বিজয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি এবং টেক্সটাইল প্রকল্পে ধারাবাহিকতা চাওয়া বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তি হতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। গত এক দশকে, বাংলাদেশ চীন থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের বিপুল বিনিয়োগ পেয়েছে, যা জাপানের ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগকে ছাড়িয়ে গেছে।
আপনি যদি ভারত বা চীন হন তবে আপনি মনে করবেন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখলে আপনার জন্য আরও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে, বলেছেন ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পিয়েরে প্রকাশ। তারা এটিকে এভাবেই দেখে। সোমবার তার সরকারি বাসভবনে নির্বাচন-পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে অভিহিত করেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি নিজেই ভবিষ্যতের সমস্যাগুলির দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের ধৈর্য্য দেখিয়েছি এবং আমরা জনগণের অধিকার নিশ্চিত করেছি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ দেশে গণতন্ত্র যাতে অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি শেখ হাসিনার নিরলস হয়রানি বাংলাদেশকে তার গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত করেছে। প্রকাশ বলেন, সুস্থ ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের নিরিখে এই নির্বাচন গণতন্ত্রের কফিনে পেরেকের মতো মনে হচ্ছে। আপনি একটি কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা, বাক স্বাধীনতা হ্রাস, ধর্মের স্বাধীনতা হ্রাস এবং গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি হ্রাস দেখতে পাবেন। আপনি ধারণা করতে পারেন যে, সরকারের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করা অন্য যেকোনো কিছুর উপর দমন আরও বাড়তে যাচ্ছে।
‘বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন শেখ হাসিনা। ফলে এ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার আশ”ঙ্কা প্রকাশ করেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশজুড়ে ছোটখাটো সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, অগ্নিসংযোগকারীরা কয়েকটি ভোটকেন্দ্রসহ অন্তত ১০টি গাড়ি ও বেশ কয়েকটি স্থাপনায় আগুন দিয়েছে।
ভোটের দিন ঢাকার হাজারীবাগে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে বোমা বিস্ফো’রণে এক শিশুসহ তিনজন আহত হয়েছেন। নির্বাচনের আগে বিএনপির সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই ঘটনায় চারজন নিহ”ত ও আটজন আহত হন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী সতর্ক করেছেন যে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আধিপত্যকে সুসংহত করার সাথে সাথে সমালোচনামূলক কণ্ঠের দমন আরও তীব্র হতে পারে। এটি টানা তৃতীয় নির্বাচন যেখানে বাংলাদেশিরা তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। উল্টো, সরকারের কোনো সমালোচনা আরও দমন-পীড়নের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশ”ঙ্কা করছেন অনেকে।