বেশ কিছু দিন ধরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে চলছে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা। তবে সকল আলোচনা-সমালোচনা প্রতিরোধে নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রীসভা। তবে এবারের নির্বাচনে এই আইন কর্যাকর হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। তবে পরবর্তী কমিশন গঠনে এই আইন কার্যকর হবে। এদিকে এই আইন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত উঠে এলো প্রকাশ্যে।
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সরকার যে আইন নিয়েছে তা সম্পূর্ণ নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদিত বিলে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিধান রয়েছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে অতীতে গঠিত নির্বাচন কমিশন সফল হয়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হলে দলগত পদবি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল আলাপকালে তারা এসব প্রশ্ন করেন। সাবেক ব্রিগেডিয়ার নির্বাচন কমিশনার (অব.)। ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই আইন নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন নয়। তদন্ত কমিটি গঠনের আইন হয়েছে। কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ আছে। এছাড়াও, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণ না করার কারণে আইনটি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো নিয়োগ দিতে পারেন না। তিনি বলেন, সমাধান হিসেবে সার্চ কমিটি থেকে সংসদে যেতে পারত। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে বিরোধী দলীয় নেতাসহ সমান সংখ্যক সরকারি ও বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য থাকতে পারেন। এই কমিটি আলোচনা করে সেই আলোচনার ফলাফল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারে। তাহলে সাংবিধানিক বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না। ডাঃ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বিলের কাজ শেষ হয়নি। এভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হলে তা হবে রাজনৈতিক নিয়োগ। এখানে সব পক্ষ থেকে কোন উদ্ধৃতি নেই. সার্চ কমিটির মাধ্যমে কাকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তা জানার সুযোগ জনগণের নেই। এই ধরনের ক্ষেত্রে, গণশুনানি হয় বিদেশে। তাই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এত দেরিতে এ ধরনের আইন প্রণয়নের উদ্যোগও সন্দেহের কারণ হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনারের জন্য নির্বাচনী আইন করতে হলে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মানতে হবে। সংবিধানের কোথাও তদন্ত কমিটির উল্লেখ নেই। তাই তদন্ত কমিটি গঠন করতে হলে ১১৮ ধারা বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। অন্যথায় সংবিধান লঙ্ঘন করা হবে। তিনি বলেন, ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বিশেষ পরিস্থিতিতে সংলাপ করেন এবং তদন্ত কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। পরের বার সবাই তাকে অনুসরণ করবে, যা অনিয়মিত। কারণ সংবিধানে এভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কথা বলা নেই। অনিয়ম যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন তা অবাঞ্ছিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, শামসুল হুদা কমিশন মেয়াদ শেষে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের খসড়া দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার কোনো আইন করেনি। এখন হয়তো জনগণের চাপেই আইন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যা হয়েছে তা বেআইনি, অসাংবিধানিক। সব সরকারই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে, আওয়ামী লীগ সরকার করছে। আইন পাস হচ্ছে বলে খবর থেকে শুনেছি। তবে এ আইনে নতুন কমিশন গঠন করা হবে কি না, তা জানায়নি সরকার। তবে দেরিতে হলেও আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সরকারকে ধন্যবাদ জানান। সরকার চাইলে এ আইনে নতুন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের অনুরোধও করেন ড. আনোয়ার হোসেন। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাই বলছে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের সদিচ্ছার কারণে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখছি সরকার পরিবর্তন এবং সেই নির্বাচন কেমন হবে জাতীয় নির্বাচনে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য অশুভ লক্ষণ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সচিব (সুজন) বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের প্রক্রিয়া ভালো ফল বয়ে আনবে না। বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। শেষ পর্যন্ত আগের ধারা বজায় রেখে বিলটি অনুমোদন করে সরকার। অর্থাৎ সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। সেক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, রকিবউদ্দিন কমিশন এবং নুরুল হুদা কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে ২০১২ ও ২০১৭ সালের মতো অসফল প্রক্রিয়ার ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিযুক্ত এই দুটি নির্বাচন কমিশন তাদের পক্ষপাতমূলক আচরণের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে, আমাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের নিয়োগে আগ্রহী দলগুলোর মতামতের প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। অর্থাৎ অতীতের মতোই প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। আগের নির্বাচন কমিশনগুলোর বৈধতা দিতে নির্বাচনী কমিশন পদবি আইনে একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। সুজন মনে করেন, ভোটাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নির্বাচন কমিশনাররা এতে পার পেয়ে যাচ্ছেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বৈধতার মাধ্যমে অতীতের নির্বাচন কমিশনারদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের সুপিরিয়র কাউন্সিল গঠনের ব্যবস্থা না করে উল্টো তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।
এবারের দ্বাদশ নির্বাচন সার্চ কমিটির মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন সরকার। এই লক্ষ্যে কাজ করছেন বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি। ইতিমধ্যে তিনি নির্বাচনে প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য নতুন কমিটি গঠনে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই ভিত্তিতে দেশের রাজনৈতিক দল গুলোর সঙ্গে সংলাপে যুক্ত হয়েছেন তিনি। এবং জানিয়েছেন দ্রুত সময়ের মধ্যে এই কমিটি গঠন করা হবে।