সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে উঠেছে নানান রকম প্রশ্ন। বাংলাদেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ আওয়ামী লীগের ঘাঁটি নারায়ণগঞ্জ। তবে সেখানে বিভেদটা আম্লীগের ২ দলের মধ্যেই বেশি। শামীম ওসমান ও আইভী রহমান দুজনেই আওয়ামী লীগ করলেও কাজ করেন একে অপরের বিপরীতে। শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য হলেও আইভীর বিপক্ষে কাজ করেও ঠেকাতে পারেননি আইভীর জিৎ। তবে এবার প্রশ্ন উঠেছে বারবার আইভী কেন নির্বাচিত হচ্ছে! তাহলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ কি আসলেই শামীম ওসমানকে চান নাকি চান না এমনটাও প্রশ্ন উঠেছে। আইভী কি জন্য জিতল শামীম ওসমানের বিপরীত সেই কারণে নাকি নারায়ণগঞ্জবাসী আইভীকে যোগ্য হিসেবে দেখেছে সেই কারণে?
উন্নয়ন, সাহস ও সততা এই তিন গুণে নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জবাসীর মন জয় করে তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
তাদেরই ধারাবাহিকতায় এই হ্যাটট্রিক জয় এসেছে বলে মনে করছেন তারা। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আইভী নির্বাচনে পাস করলেও তারা বলছেন, এই জয় কোনো নৌকার নয়।
রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই ভোটে আইভী তার প্রতিদ্বন্দ্বী হাতির প্রধান প্রতীক স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারকে উড়িয়ে দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন। ব্যবধান ছিল ৬,৯৩১ ভোট। জয়ের পর মেয়র আইভী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) না হলে ব্যবধান আরও বড় হতে পারত।
আইভির পথ অবশ্য সহজ ছিল না। কারণ নারায়ণগঞ্জে ভোটের সমীকরণ। এখানকার হিসাব দেশের অন্যান্য ১০টি এলাকার থেকে আলাদা। এ জেলার রাজনীতিতে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সঙ্গে তার প্রকাশ্য বিরোধ আবারও মানুষের মুখে মুখে। আর সেই বিরোধই হয়ে ওঠে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু।
২০১৬ সালের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি পেলে আওয়ামী লীগ আইভীর ওপর নির্ভর করে। ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে ৭৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন আইভী।
নারায়ণগঞ্জ পৌরসভাকে পৌর কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়ার পর প্রথম নির্বাচন হয় ২০১১ সালে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য হলেও দলের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হন আইভী। কিন্তু তৎকালীন পৌর মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত হেভিওয়েট প্রার্থী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনী মাঠে পারিবারিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। নির্বাচনে কী হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাখো ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।
এমনকি আগের পৌরসভার নির্বাচিত সভাপতিও ছিলেন তিনি। এখন পর্যন্ত আইভীকে নির্বাচনে পরাজয় প্রমাণ করতে হয়নি। তিনি তৎকালীন জেলা বিএনপির সহসভাপতি নুর ইসলামকে পরাজিত করে পৌরসভার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, সব নির্বাচনই ছিল চ্যালেঞ্জিং। এটাও কম নয়। প্রতিটি প্রকার আলাদা। আমি এত চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলতে চাই না। নির্বাচন মানেই প্রতিযোগিতা। ‘
জয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রশ্নটি করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী।
মুখে হাসি নিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র বলেন, আমি যা করেছি বা অতীতে যা কিছু করেছি তার মূলে রয়েছে আমার জনবল, আমার বর্তমান এবং আমার সমর্থন ছাড়া। জনসমর্থন না থাকলে তিনি নারায়ণগঞ্জে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। ‘
কেন এই জনসমর্থন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন নৌকা প্রতীকের এই বিজয়ী।
আইভি বলেন, “আমরা তখনই জানতে পেরেছিলাম। আমি আপনার সাথে সম্পর্ক করার জন্য, কাজ করার জন্য, আমি যা করতে পারি তা করার জন্য আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, আমি যা পারিনি তা বলার জন্য নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমি মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসি, মানুষ আমাকে ভালোবাসে।” প্রতিবার প্রতিদান।’
নারায়ণগঞ্জে সিটিজেনস ফর গুড গভর্নেন্স (সুজন) এর সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, আইভীর সাফল্য উন্নয়ন, সাহস ও সততার সমন্বয়। প্রথমত, আপনার কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে তিনি মানুষের কল্যাণে অনেক কাজ করেছেন। এটাকে ডেভেলপমেন্ট বলুন বা অন্য কোন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করুন। এটি শহরের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘
ধীমান সাহা বলেন, সাফল্যের দ্বিতীয় কারণ সেলিনা হায়াৎ আইভীর সততা।
“আমরা তখনই বুঝতে পেরেছি। একজন মানুষ ১০০ শতাংশ সৎ নয়। তিনি ৯৯ শতাংশ সৎ ছিলেন। শহরবাসী তা দেখেছেন। তার কাজে স্বচ্ছতা ছিল, সততা ছিল। সততা এবং দায়িত্ব ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি মেয়র আইভীর পেছনে অন্তত শতাধিক বিরোধীদের ক্যামেরা ছিল। আমি এখানে আক্ষরিক ক্যামেরার কথা বলছি না, আমি দৃষ্টির কথা বলছি। এত কিছুর পরও সে তার কাজ করে গেছে। তাই সততা ও স্বচ্ছতা নিয়ে আমার কিছু বলার আছে বলে মনে করি না। ‘
আইভীর ‘সাহস’ তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়।
ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, “কোনও ভবন ভাঙার প্রয়োজন হলে বা কাজে যেতে গিয়ে কেউ সামান্য আহত হলে দশ জনের সুস্থতার জন্য করা হয়েছে। এই সাহস অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির মধ্যে দেখা যায় না। ‘
নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধের কথা উল্লেখ করে ধীমান সাহা বলেন, “সাহস দুই ধরনের। একটি হলো কাজ করার সাহস। আরেকটি হলো নারায়ণগঞ্জে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস। সততার সাথে কাজ করা। , ভালো শক্তি দিয়ে খারাপ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা। প্রতিটি জেলায় অশুভ শক্তি রয়েছে। প্রতিটি জেলায় একাধিক অশুভ শক্তি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শুভ শক্তি। শুভ শক্তির সমন্বয়, অশুভ শক্তিকে পরাজিত করার সাহস।
যদিও এখানে শামীম ওসমানকে কিছুটা অশুভ শক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে, তবে এসব বিষয় নিয়ে সরাসরি আইভী শামীম ওসমানকে কোনভাবে দোষারোপ করেননি।তবে এ ব্যাপারে শামীম ওসমানের মুখ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো কথা শোনা যায়নি। এতটুকু বলা চলে নিজ দলের ভেতর এমন দ্বন্দ্ব, এটা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর। দ্বন্দ্বটা শুরু ছিল ভোটে প্রথমবার আইভীর কাছে শামীম ওসমানের পরাজয়ের ঘটনা থেকে নাকি পূর্ব থেকেই সেটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি।