বেশ কিছু দিন ধরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা বিরাজ করছিল। তবে সকল আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে গতকাল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে মেয়র পদে জয় লাভ পেয়েছেন আওয়ামীলীগ দলের মনোনীত প্রার্থী আইভী রহমান। এই নির্বাচনকে ঘিরে নির্বাচন কমিশনাররাও নানা ধরনের কথা বার্তা বলেছেন। তবে এবার এই বিষয় নিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন প্রভাষ আমিন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ও সমীকরণ ছিল। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলের বহিষ্কৃত নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনকে আরও উত্তেজিত করেছেন। তবে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে প্রার্থী না হলেও শামীম ওসমান বরাবরই আলোচনায় ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের এমপি হলেও তার সমর্থন অস্পষ্ট ছিল। নানা রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও দলটির প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থনের ঘোষণা দিলেও মাঠে শামীম ওসমানের অবস্থান স্পষ্ট নয়। শামীম ওসমান প্রার্থীকে সমর্থনের ঘোষণা না দিলেও দলীয় প্রতীকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। তবে আইভী কখনই শামীম ওসমানের সমর্থন চাননি বরং বারবার শামীম ওসমানকে প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। খন্দকার শামীম ওসমানের প্রার্থীকে ডেকেছেন তৈমুর আলম। আইভী জানতেন শামীম ওসমানের সমর্থন বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তবে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে দুজনের ভাবমূর্তির বড় পার্থক্য রয়েছে। এত শঙ্কা, এত সমীকরণ, এত হিসাব-নিকাশ কাটিয়ে অবশেষে জিতে হ্যাটট্রিক ড. সেলিনা হায়াৎ আইভী। জনগণের পাশে থাকলে তা দেখালেন তিনি।
আর সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন আসলে তার পারিবারিক উত্তরাধিকার। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন হওয়ার পর তিনটি নির্বাচনেই তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ছিলেন। সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকা দুবার নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রায় ৭০,০০০ ভোট পেয়ে আইভী সফলভাবে পারিবারিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। আইভীর ব্যক্তিগত জয়ের চেয়ে নারায়ণগঞ্জের বাছাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন পর একটি নির্বাচন সারা দেশে স্বস্তি এনে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ক্ষমতাসীন দল যাকে ইচ্ছা পাস করবে, ব্যর্থ হবে; ভোটাররাই নয়, পুলিশ ও প্রশাসনই নির্বাচনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা থাকলেও নির্বাচন কমিশন সবসময়ই সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
যেখানে নির্বাচন কমিশনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার কথা সেখানে কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ অবস্থায় সব ভোটার ও প্রার্থী নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটাররাও নির্বাচনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। প্রধান বিরোধী দল মাঠে না থাকায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেল একতরফা, একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে সেখানে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আসে। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও তৈমুর আলম খন্দকারের পক্ষে মাঠে সক্রিয় ছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। আর আগেই বলেছি, আইভী-শামীম ওসমানের দ্বন্দ্বও নির্বাচনে দারুণ আবেগ নিয়ে এসেছে। সবকিছু দুর্দান্তভাবে শেষ হয়েছিল। আইভীর বিজয়ের চেয়ে গণতন্ত্রের বিজয় বেশি স্বস্তিদায়ক। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের হারানো আস্থা বিস্ময়করভাবে ফিরে এসেছে। সকাল থেকেই শহরে ছিল দীর্ঘ লাইন। বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো মা/রা/মা/রি নেই, কেন্দ্র দখল নেই, বহিষ্কারের কোনো খবর নেই। দিনভর নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও পরাজয়ের পর একাধিক অভিযোগও করেছেন তৈমুর আলম। তার সব অভিযোগই ছিল নির্বাচনপূর্ব গ্রেফতার ও ইভিএমের বিরুদ্ধে। হেরে যাওয়ার অভিযোগ আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশ। তৈমুর আলম খন্দকারের সব অভিযোগ সত্য হলেও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন হবে ভালো নির্বাচনের দৃষ্টান্ত।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ এখন শেষের দিকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এটাই তার শেষ বড় নির্বাচন। গত পাঁচ বছর ধরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কমিশনের ‘বিবেকের’ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সব সময়ই নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা, অদক্ষতা, নতজানু রাজনীতি এবং ভেঙে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। তিনি সর্বদা তার বিরোধিতা উচ্চস্বরে প্রকাশ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে তিনি দিনভর বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। সকালে একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি বিদায়ী অনুষ্ঠানে একটি ভালো নির্বাচন দেখতে চাই। আপনার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। নির্বাচনের পর রাতে কমিশনে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেষটা ভালো, সব ঠিক আছে। বর্তমান কমিশনের অধীনে এটাই সেরা নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দাবি পূরণ হয়েছে। এখন আপনাকে সম্ভাব্য নতুন নির্বাচন কমিশনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। বর্তমান কমিশন যেখান থেকে ছেড়ে দিয়েছে সেখান থেকেই এগুলো শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে। স্থানীয় নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। তবে নারায়ণগঞ্জে ফিরতে আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন ভালো নির্বাচন করতে চাইলে এই বিশ্বাস অটুট রাখতে হবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা কমিশনারদের কার্যক্রম সমাপ্ত হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। অবশ্যে এই কমিশনারদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। তবে তারা তাদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এমনকি তারা জানিয়েছে দেশে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।