কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে দেশের ৭ উর্ধ্বতন প্রশাসন কর্মকর্তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞাকে ঘিরে এক অস্তিতিশীল পরিবেশের মধ্যে পতিত হয়েছে। এবং বাংলাদেশ সরকার পড়েছেন নানা ধরনের প্রশ্নের মুখে। এছাড়াও এই অভিযোগের ভিত্তিতে মার্কিন সামরিক অনুদান নিয়ে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। অবশ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কিছু শর্ত দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ এখনও শর্তের বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ করেনি। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিষয়ে মতামত প্রকাশ করভে বলে জানিয়েছে। এবং এক্ষেত্রে কিছু দিনের সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।
কোন কোন বাহিনীর উন্নয়নে কীভাবে অনুদানের অর্থ ব্যয় হবে-তা আগাম জানানোর নতুন শর্তে মার্কিন সামরিক অনুদান গ্রহণে বাংলাদেশ রাজি কিনা? তা জানতে চায় ওয়াশিংটন। ১লা ডিসেম্বর ঢাকায় পাঠানো চিঠিতে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক জবাবে অর্থাৎ ‘সম্মতিপত্র’ পাঠানোর সময় বেঁধে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা শেষ না হওয়ায় ১৫ দিনের সময় বাড়ানোর অনুরোধ করে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে তাতে আপত্তি করা হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় দফায় সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের দায়িত্বশীল একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। জানিয়েছে, মার্কিন অনুদান গ্রহণে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াশিংটনকে এ সংক্রান্ত ‘সম্মতিপত্র’ পাঠাতে ঢাকা নতুন করে আরও কিছু সময় চেয়েছে। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কূটনৈতিক পত্র (নোট ভারবাল) পাঠিয়ে ওই সময় চাওয়া হয়েছে। তবে আগের চিঠিতে যেভাবে দিন-তারিখ উল্লেখ করে ১৫ দিনের অর্থাৎ ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছিল, এবার তা করা হয়নি। জবাব পাঠানোর টাইমলাইনের বিষয়টি ওপেন রাখা হয়েছে। ঢাকার কর্মকর্তারা অবশ্য দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার মধ্যকার আলোচনা শেষ হবে এবং কালবিলম্ব না করেই ঢাকার ‘সম্মতিপত্র’ ওয়াশিংটনে পাঠানো হবে।’ দ্বিতীয় দফায় সময় চাওয়া হতে পারে এমন ইঙ্গিত ছিল পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের গত সপ্তাহের বক্তব্যে। ৩০শে ডিসেম্বর গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তিনি এ আভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘এর সঙ্গে জড়িতদের (অভ্যন্তরীণ) আলোচনায় আরও কিছু সময় প্রয়োজন, আমরা সেটা চাইতে পারি।’
উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে প্রবর্তিত মার্কিন লিহেই আইনে সমপ্রতি সংশোধনী আনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কাছে লিহেই আইনের সংশোধনী শেয়ার করেছে। সর্বজনীন ওই আইনে নতুন সংযোজিত ধারায় বলা হয়েছে, কোনো দেশের নিরাপত্তা সংস্থা বা বাহিনী যদি নি/র্যা/ত/ন, আইনবহির্ভূত হত্যা, গু/ম ও ধ/র্ষ/ণ/জ/নি/ত কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে ওই সংস্থাকে অনুদান দিতে পারবে না মার্কিন সরকার। এক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে এমন কোনো সংস্থা বা বাহিনীও অনুদান পাবে না। বাইডেন প্রশাসনের বৈশ্বিক অনুদান বিষয়ক ওই অবস্থান বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য জানিয়ে সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন থেকে মার্কিন অনুদান যেসব দেশ পেতে চায় তাদের বরাদ্দ কোন কোন বাহিনী পাবে এবং তা কীভাবে হচ্ছে তা আগেভাগে জানাতে হবে। ফলে সংশোধিত লিহেই আইনের কারণে বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক অনুদান গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর এ সম্পর্কিত আগাম তথ্য সরবরাহের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো ওই আইনের সংশোধনী ১লা জানুয়ারি থেকে কার্যকরও হয়ে গেছে। এ জন্য এখন থেকে মার্কিন অনুদান পেতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকে নতুন শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুদান গ্রহণে রাজি মর্মে আনুষ্ঠানিক ‘সম্মতিপত্র’ পাঠাতে হবে। স্মরণ করা যায়, অতীতে শর্তহীনভাবে বাংলাদেশকে বিরাট অঙ্কের সামরিক অনুদান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল না বা কোনো শর্ত ছিল না। বন্ধু রাষ্ট্রের ওই অনুদান দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যয় হয়েছে। এ নিয়ে গত ২৮শে ডিসেম্বর, ২০২১ এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের বলেন, নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত (সেফ গার্ড) রেখেই সম্মতিপত্র পাঠানো হবে। ওই পত্রে বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রদেয় সামরিক অনুদান কোথায় ব্যবহার হবে সে বিষয়ে মার্কিন আইনের বাধ্যবাধকতার বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন- আমরা এ বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত। তাদের সব শর্তই মোটামুটিভাবে আমরা মানি। এখন আমরা আমাদের জবাবের ভাষা নিয়ে কাজ করছি। যুক্তরাষ্ট্র প্লেন ফরম্যাটে এ বিষয়ে বাংলাদেশের সম্মতি জানতে চেয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, আমাদের সেফ গার্ড বজায় রেখেই আমরা সম্মতির কথা জানিয়ে দিবো। বাংলাদেশ কী কী বিষয়ে জোর দিচ্ছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, অনুদান প্রদান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বক্তব্য থাকলে তা যাতে আগেভাগে জানানো হয় অর্থাৎ আগাম কনসালটেশন, নির্ভরযোগ্য প্রমাণের সূত্র এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ চাই আমরা। যদি কোনো সংস্থাকে তাদের অনুদান দিতে আপত্তি থাকে তবে তারা যেন সেটি জানায় এবং আমরা যেন তা নিয়ে আলোচনা করতে পারি- এটা নিশ্চিত করেই মার্কিন লেহি অ্যাক্টের অধীনে অনুদান পাওয়া সংক্রান্ত সম্মতিপত্র পাঠাবো। মার্কিন অনুদান পেতে নতুন শর্ত যুক্ত করার বিষয়টি গত ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে র?্যাব এবং বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির অন্তত ৯ দিন আগের। নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সামরিক অনুদান সংক্রান্ত শর্তাবলী জুড়ে দেয়ার সম্পর্ক আছে বলে মনে করে না সেগুনবাগিচা। কর্মকর্তাদের মতে, কাকতালীয়ভাবে ৯ দিনের ব্যবধানে দু’টি ঘটনা সামনে এসেছে। এ জন্য সরকার দু’টি বিষয়কে সমান গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার অনুদান পেয়েছে। ওই সহায়তার উল্লেখযোগ্য অংশ বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে দুটি হ্যামিলটন কাটার নৌজাহাজ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীকে সহায়তার জন্য ৫০টি মাল্টি রোল আর্মাড পার্সোনাল ক্যারিয়ারও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে দেশটি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০১২ সালে ১৮ কোটি ডলারের চারটি সি-১৩০ পরিবহন বিমান পেয়েছে বাংলাদেশ। সমপ্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১১০ কোটি টাকা মূল্যের ড্রোন দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে ২০২০ সালের জুলাই মাসের এক ঘোষণা মতে র্যাব এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে সব রকম অনুদান প্রদান বন্ধ রেখেছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
গোটা বিশ্বের মোড়ল খ্যাত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধশালী। এই দেশ প্রায় সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর নানা বিষয়ে হস্ত ক্ষেপ করে থাকে। এরই সুবাধে দেশটির বেশ কিছু আর্ন্থাজাতিক পর্যায়ে সংস্থা রয়েছে যারা বিভিন্ন বিষয়ে উপর জরিপ করে নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। অবশ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক পজেটিভ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে দেশটি। তবে সম্প্রতি প্রকাশ করা প্রতিবেদনটিকে ঘিরে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। তবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে নিরলস ভাবে চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার।