২৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী একটি লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঐ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪২ জনের মৃ/ত্যু/র খবর পাওয়া গেছে। এবং অনেকেই গুরুত্ব দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে অনেকেই সাঁতার কেটে নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন ইউএনও মুজাহিদ। এবার তিনি নিজেই জানালেন ঘটনাটির বিস্তারিত।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ। সস্ত্রীক ঢাকা থেকে বরগুনায় ফিরছিলেন ওই লঞ্চে। অনেক যাত্রীর পাশাপাশি ভাগ্যক্রমে তিনি এবং তার স্ত্রীও তীরে ভিড়তে পেরেছেন।
বিভীষিকাময় সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ। তিনি বলেন, রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে। হয়তো ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল অথবা ইঞ্জিনে কোনো সমস্যা ছিল। সব মিলিয়ে ওখানে আগুন ধরে। এরপর ইঞ্জিনের কাছে যারা ছিল তারা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তারা বিষয়টি গোপন রাখে, কাউকে জানায়নি। অন্য কারও সাহায্যও নেয়নি। যাত্রীদেরও জানায়নি। অন্তত ২০-২৫ মিনিট যখন হয়ে গেছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, যখন দেখেছে আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন ঘোষণা দেয় যে যার মতো বেরিয়ে যান, বাঁচুন, ইত্যাদি।’
ইউএনও মুজাহিদ নিজের অবস্থা নিয়ে বলছিলেন, রাত ৩টার সময় রুম বয় আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে জানায় যে, লঞ্চে আগুন লেগেছে, নামেন। ‘তখন কোথায় নামব? নামার তো উপায় নেই। আমি ছিলাম দ্বিতীয় তলায় কেবিনে। আগুন লেগেছে নিচ তলার ইঞ্জিনে, এক কর্নারে। তখন দেখি প্রচণ্ড ধোঁয়া। তখনও আগুন সম্পূর্ণ লাগেনি, সামনের দিকে ছড়ায়নি। কিন্তু ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে সবকিছু। হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ বলেন, লঞ্চের প্রায় সবাই ঘুমে ছিল। ঘুম থেকে উঠে লঞ্চের দোতলার ডেকে দাঁড়াই। সেখানে প্রায় এক থেকে দেড়শো লোক দাঁড়ানো। আরও অনেকে ভেতরে, পেছনে ছিল। সেখানে এত ধোঁয়া যে ধোঁয়াতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমার যেটা মনে হয় যে এই ধোঁয়াতেই অনেক মানুষ অজ্ঞান হয়ে গেছে। তখন আমি চিন্তা করলাম যে এখানে থাকলে হয়তো বাঁচা যাবে না। যদিও আগুন সে পর্যন্ত আসেনি, তবে ধোঁয়াতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
এর প্রায় ১৫ মিনিট পরে আমার স্ত্রী এবং আমি, রেলিং ক্রস করে লাফ দিয়ে নিচ তলার ডেকে পড়ি। স্ত্রী আগে লাফ দেয়। এতে তার পা ভাঙলেও সেসময় বুঝতে পারেনি। তিনি বলেন, লঞ্চ তখন মাঝনদীতে ছিল। তখন যাদের হয়তো শক্তি সামর্থ্য আছে বা যারা অভ্যস্ত তারা লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে এবং সাঁতরে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করে। সে সময় যারা পেরেছে তারা সাঁতরেই পাড়ে গেছে। ‘এ সময় লঞ্চে আটকা পড়ে যায় মূলত তারা যাদের বাচ্চা আছে। কারণ বাচ্চা নিয়ে তারা লাফ দেওয়ার সাহস পায়নি। বাচ্চাকে বাঁচাবে নাকি নিজে বাঁচবে? কিন্তু পরে যখন আগুনের তীব্রতা বাড়ে তখন যারা পেছনে ছিল বা ভেতরে ছিল, তারা আর ভিড় ঠেলে সামনে আসতে পারেনি। তারা সেখানে আগুনে দগ্ধ হয় বা ধোঁয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’ বিভীষিকার বর্ণনা দিয়ে মুজাহিদ বলেন, আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে অনেকে লাফ দিলেও আমি লাফ দেইনি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম যে, কোনো একটা সাহায্য আসবে বা লঞ্চটা তীরে ভিড়বে। কিন্তু কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আসেনি। সেখানে তখন একটা বীভৎস দৃশ্য। মানুষের আহাজারি, দোয়া-দুরুদ…সে পরিস্থিতি বর্ণনা করার মতো না।
প্রায় সময় নৌপথে যান্ত্রিক ত্রুটি এবং অসাবধানতার কারনে দূর্ঘটনার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে প্রান হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। প্রতি বছরেই লঞ্চের এমন দূর্ঘটনার তথ্য উঠে আসছে নানা মাধ্যমে। ২৩ ডিসেম্বর ঘটে যাওয়া লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নানা অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে প্রকাশ্যে। ইতিমধ্যে ঘটনাটির সুষ্ঠ তদন্ত করে অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা।