খুলনার কুখ্যাত ৮ বিবাহিতা সুলতানা পারভীন নীলা ওরফে বৃষ্টি ও তার কাজী আবু সালেহ মোহাম্মদ নুরুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
বুধবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে অতিরিক্ত প্রথম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক সুলতান সোহাগ উদ্দিন ওই তরুণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী ওয়াদুদ শাহীন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ২০২২ সালে নীলার সপ্তম স্বামী এম রহমানের দায়ের করা মামলার তদন্তভার ঢাকার সিআইডি পুলিশের ওপর ন্যস্ত হয়। দীর্ঘ তদন্তের পর সিআইডি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায় এবং সে বছরই আদালতে চার্জশিট জমা দেয়।
বুধবার উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি শেষে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে আদালত নিশ্চিত হওয়ায় সুলতানা পারভীন নীলা ও কাজী আবু সালেহ মো নুরুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অপর দুই আসামির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে বিয়ে ও চেক গ্রহণের মামলায় সুলতানা পারভীন নীলার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
অভিযোগ, নিজের সৌন্দর্যকে পুঁজি করে নিজের নাম পরিবর্তন করে কুমারী হওয়ার ভান করে ৮ বার বিয়ে করেছেন। এবং মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিনি তাদের সবাইকে তালাক দেন। প্রতারণার দায়ে জেলও খেটেছেন তিনি।
মামলার হলফনামা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তার জাতীয় পরিচয়পত্রে সুলতানা পারভীন ওরফে নীলা তার নাম। প্রতারণার জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি, রুমাইনা ইয়াসমিন রূপা, নাজিয়া শিরীন শিলা, স্নিগ্ধা আক্তার বলে পরিচয় দিতেন।
নিজের সৌন্দর্য এবং কথার জালে আটকান প্রবাসী, ধনী এবং ব্যবসায়ীদেরকে। নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে ৮টি বিয়ের করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব বিয়েই ছাড়াছাড়ি হয়েছে বিয়ের অল্প কিছু দিনের মধ্যে।
মামলার ভয় দেওয়াসহ বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিয়ে কৌশলে টাকা, বাড়ি নিয়েছেন নিজের করে। এইসব স্বামীদের করেছেন সর্বশান্ত। বার বার বিয়ে করা এবং অর্থ সম্পদ নিয়ে ছাড়াছাড়ি মতো প্রতারণাই এই সুন্দরী নারীর মূল পেশা।
তার এই প্রতারণা পেশার প্রধান সহকারী তার ভাই এবং পরিবার। গতবছর এমন প্রতারণা করতে গিয়ে সাবেক এক স্বামীর করা মামলায় জেলও খেটেছেন তিনি।
বিয়ে ছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড। আমলা, রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে রয়েছে তার উঠাবসা।
১৯৯৯ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার প্রথম বিয়ে হয় মাদারীপুর জেলার হরিকুমারিয়া গ্রামের আব্দুল হাকিম শিকদারের জাপান প্রবাসী ছেলে শাহাবউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে। তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালামাল চুরির ঘটনায় মাদারীপুর সদর থানায় একটি জিডি করেন শাহাবউদ্দিন। পরে ২০০১ সালে শাহাবউদ্দিনের সঙ্গে বৃষ্টির বিচ্ছেদ হয়।
দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০০৫ সালে এসএম মুনির হোসেনের সঙ্গে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে বিয়ে করেন খুলনা নগরীর খালিশপুর এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে ঠিকাদার মইনুল আরেফিন বনিকে। নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় বৃষ্টির বিরুদ্ধে মামলা করেন স্বামী বনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। তবে যথারীতি টাকা আদায় করতে বনির বিরুদ্ধেও খুলনার বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা করেন বৃষ্টি।
বনির সঙ্গে মামলা চললেও ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জের ইফতেখার নামে আরেকজনকে বিয়ে করেন। এরপর ২০১২ সালে বাগেরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসেনকে বিয়ে করেন।
২০১৭ সালে ইতালি প্রবাসী মাদারীপুরের মোহাম্মদ আজিম, ২০১৮ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মোহাম্মদ রহমান এবং ২০১৯ সালে খুলনা মহানগরীর নাজির ঘাট এলাকায় মো. আব্দুল বাকীকে বিয়ে করেন।
আট নম্বর স্বামী মো. আব্দুল বাকীর সঙ্গে প্রতারণা করায় বৃষ্টির বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে চেক ও টাকা-পয়সা চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাটি বর্তমানে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে।
এছাড়া সিরাজগঞ্জে থাকার সময় ঢাকার একটি ফ্ল্যাট নিজের নামে লিখে না দেয়ায় আরো এক স্বামীকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো হয়। ওই ঘটনায় প্রতারক বৃষ্টির বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২ মে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় জিডি করা হয়।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে আফরিন আহমেদ নামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন সুলতানা বর্ষী। সেই সুযোগে তিনি এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একটি চেক পাতা চুরি করে অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগে মামলা হয়। মামলাটি বর্তমানে পিবিআই খুলনা কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে।
এভাবে প্রত্যেকেবিবাহিত নারী হয়েও নিজেকে কুমারী বলে পরিচয় দিতেন। বিয়ের পর মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে স্বামীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। বৃষ্টির অত্যাচার সইতে না পেরে দুই স্বামীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
খুলনা জেলা রেজিস্ট্রারের অনুমোদিত তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাওলানা আ স ম নুরুল হক সুলতানা পারভীনের নিকাহ রেজিস্ট্রার। যিনি বৈধ নিবন্ধিত নিকাহ রেজিস্ট্রার নন। এই ভুয়া নিকাহ রেজিস্টার দিয়ে প্রতারণা করে এমন অসত কাজ করতেন। বিয়ের পর সংসার চালানো, নিজের খরচ, দেনমোহর ও স্বামীর থাকা ফ্ল্যাট নিজের নামে করতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন নীলা।