আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। একই দিনে পাল্টা সমাবেশের ডাক দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। তাই পুলিশ প্রশাসন বেশ তৎপর অবস্থানে রয়েছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের ধরপাকড় এড়িয়ে সারাদেশের নেতা-কর্মীদের ২৫ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। যাদের ঢাকায় থাকার সুযোগ নেই তাদের ঢাকার আশপাশের এলাকায় এসে থাকতে বলা হয়েছে।
সমাবেশের আগের দিন বা সমাবেশের দিন তারা ঢাকায় সমাবেশে যোগ দেবেন। নেতারা বলছেন, ওই সমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে। তাই বিএনপি তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঢাকায় ব্যাপক জনসমাবেশ নিশ্চিত করতে চায়।
বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজলে হুদা বাবুল বলেন, এখন আলাদা নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মহাসমাবেশে সকল সহযোগী সংগঠনের সকল স্তরের নেতাকর্মীরা উপস্থিত থাকবেন।
ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরা ১৮ তারিখের সমাবেশে আসতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু তারপরও তারা ঢাকা এসেছেন। সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। আর এবার তো মহাসমাবেশ। তাই সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ঢাকা আসবেন। অনেকে এরইমধ্যে আসতে শুরু করেছেন।’
জানা গেছে, পুলিশি গ্রেফতারের মুখে বিএনপি মনে করছে, সমাবেশের দু-একদিন আগে ঢাকায় প্রবেশে কঠোরভাবে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। কৌশলে বাস ও লঞ্চ অবরোধ করা হতে পারে। পথে পথে নেতা-কর্মীদের আটক করা হতে পারে। তাই তাদের ২৫ তারিখের মধ্যে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। আর তাদের যেকোনো উপায়ে গ্রেফতার এড়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এমনকি ঢাকায় আসার পর হোটেলে না থেকে আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনের বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মেসে ওঠাও নিষেধ। আর কোনো বাস বা মাইক্রোবাস ভাড়া না নিয়ে সাধারণ যাত্রীর মতো যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ বা ট্রেনে সবাইকে আসতে বলা হয়েছে।
বাড়তি কৌশল হিসেবে নেতা-কর্মীদের স্মার্ট ফোনের পরিবর্তে বাটন মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আর স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও ফোনের মধ্যে এমন কিছু রাখতে না করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় তিনি বিএনপির কর্মী।
বিএনপির কৌশল হলো, পুলিশি বাধা ও তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতা-কর্মী যাতে সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসতে পারেন। রাস্তাঘাট বা আসার পথে কোনো শোডাউন করে বিপদ ডেকে না আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমাবেশ করার জন্য ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে লিখিত অনুমতি চেয়েছে বিএনপি। এর আগে গত ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে সমাবেশ করার অনুমতি পাননি তারা। সেটা মাথায় রেখেই কাজ করছেন তারা।
সমাবেশের আগের দিন অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর বিএনপির নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে অবস্থান নিতে পারেন। বিএনপি মনে করে, আন্তর্জাতিক চাপের কারণে এবার সমাবেশ স্থলে বা এর আশপাশে প্রকাশ্যে কোনো আক্রমণাত্মক ভূমিকায় যেতে পারবে না পুলিশ। তবে ঢাকাসহ সারাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে পুলিশ। আর সেখানে নেতা-কর্মীদের কৌশলী হতে বলা হয়েছে।
কৌশলের অংশ হিসেবে এলাকায় যেন কোনো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার বা আটকের মুখে পড়তে না হয়, সে জন্য এলাকা ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান নিয়ে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে।
বিএনপির একজন নেতা বলেন, ‘আসলে আমাদের একক কোনো কৌশল নেই। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা বারবার কৌশল পরিবর্তন করব। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোক নিয়ে মহাসমাবেশ করা। আমরা যেখানে বাধার মুখে পড়ব, সেখানে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ জন্য সবাই কেন্দ্রের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে কাজ করবেন। কার সাথে যোগাযোগ করবেন তাও ঠিক করা হয়েছে।
বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি। কেন্দ্র থেকে উপজেলা পর্যন্ত সবাই সতর্ক আছেন। সব পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীরা সমাবেশে আসবেন। দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সবাই আসবেন।’
যেহেতু পুলিশ ইতিমধ্যেই উপজেলার সর্বত্র নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে, তাই সবাইকে যথাসম্ভব গ্রেফতার এড়াতে বলা হয়েছে। আর সমাবেশের আগে তাকে ঢাকায় আসতে বলা হয়েছে। যার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসতে বলা হয়েছে।
মোশাররফ মনে করেন, সরকার যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন, তাদের পক্ষে বিধানসভায় জনসমাগম বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তিনি বললেন, ‘মানুষ আসবে। আমি আশা করি এটি স্মৃতিতে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হবে।
সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ঢাকা অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, অবস্থান কর্মসূচি বা হরতাল হতে পারে। তবে মূল ইস্যু হলে সমাবেশের পর কর্মসূচি থেমে থাকবে না। ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে পতন করাই আমাদের লক্ষ্য।
তবে রোববার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক যৌথসভা শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘দলের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় এসে বসতে ও পতনের এক দফা দাবি পড়তে বলা হয়নি। ২৮ অক্টোবর সরকার। আমরা বলেছি, ২৮ তারিখের কর্মসূচির পর সবাই যার যার অবস্থানে যাবে এবং পরবর্তী কর্মসূচির জন্য অপেক্ষা করবে।আমরা ২৮ তারিখ এমন কোনো কর্মসূচি দেব না যে ঢাকায় বসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছি। আপনারা লক্ষ্য করেছেন, জোর গলায় বলতে পারি এখন পর্যন্ত কোথাও আমরা অশান্তির সৃষ্টি করিনি। যা কিছু করছে সরকার ও তার পেটোয়া বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।’
বিএনপির আন্দোলনে বাধা না দিতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখ হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ। আমরা আশা করি সারাদেশ থেকে শান্তিকামী মানুষ আসবে। তাদের দাবী জোরে সোচ্চার হবে। এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।
এদিকে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পরপরই বিএনপি ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি শুরু করতে পারে বলে মনে করছে সরকার। তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকায় অবস্থান নিতে পারেন। সেই আশঙ্কার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই। এজন্য নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতে বলা হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। ওইদিন তারা বিশাল জনসমাবেশ করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। তবে সমাবেশে লোক আনা তাদের মূল বিষয় নয়, তারা সেদিন ঢাকার রাস্তা-অলিগলি ও পাড়া মহল্লা সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে নেতা-কর্মীদের সতর্ক অবস্থানে থেকে শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করতে বলা হয়েছে।
ঢাকার কলাবাগান এলাকায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘২৮ তারিখকে সামনে রেখে আমরা এরইমধ্যে কাজ করছি।আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আমরা ওই দিন রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেব। আর বিএনপির লোকজনের গতিবিধিও আমরা নজরে রাখছি।’
এদিকে পুলিশ নগরীতে সার্বক্ষণিক তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। তাদের নজর এখন হোটেল ও মেসে। তারা স্থানীয় পর্যায় থেকে তথ্য নিয়েও কাজ করছেন। পুলিশের টার্গেট ঢাকার প্রবেশপথে ব্যাপক তল্লাশি চালানো এবং সমাবেশের আগে জনসাধারণের চলাচল সীমিত করা। আর পরিবহন ও লঞ্চ মালিকরা যানবাহন চলাচল বন্ধ করবে কি না তা এখনো জানা যায়নি।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএস কামাল হোসেন বলেছেন, ‘আমরা আশঙ্কা করব কেন? বিএনপি নেতারাই বলেছেন, তারা ২৮ তারিখ সমাবেশের পর অবস্থান নেবে। সমাবেশ করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু অবরোধ, অবস্থানের নামে যদি রাস্তা ঘাট দখল করে, সাধারণের চলাচল বিঘ্নিত করা হয়, তাতো করতে দেয়া হবে না। সাধারণ মানুষ তাদের পিটিয়ে উঠিয়ে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সবাই এক হয়ে গেছে। তারা ঢাকায় লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারে।
তিনি বলেন, “সেদিন আমরা ঘোষণা দিয়ে মাঠে রয়েছি। আমরা শান্তি সমাবেশ ডেকেছি। কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করা হবে।”