বর্তমান সময়ে টাকার জাল নোট এবং জাল সনদের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে। মাঝে মাঝেই এই চক্র ধরা পড়ছে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে। আর তাদের কাছ থেকে উঠে আসছে তাদের এই সকল জাল সনদ এবং জাল টাকা তৈরীর কৌশল ও সেগুলো ছড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমের বিষয়টি। তবে জাল নোট তৈরীর ঘটনায় যে বিষয়টি সামনে আসে সেটি হলো কোনো বড় ধরনের উৎসব বা মেলাকে ঘিরে তারা জাল নোট ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। ঢাকায় শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আর এই মেলা চলবে মাস জুড়ে। আর এই মেলাকে সামনে রেখে কোটি টাকারও বেশি জাল নোট বাজারে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঢাকার মিরপুরের পল্লবী এলাকার একটি বাড়িতে।
ঘরে বসে কম্পিউটারে প্রিন্ট করে এসব টাকা তৈরি করছিলেন ছগির হোসেন ও তার দলের সদস্যরা। গত ১০ বছর ধরে এমন জাল টাকা তৈরি করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন তারা। কয়েক হাত ঘুরে ভোক্তা পর্যায়ে এসব জাল নোট ছড়িয়ে দিতে দেশজুড়ে ছিল ডিলার। পুরো ১ লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে খরচ হতো ৪ হাজার টাকা। এরমধ্যে ১ হাজার টাকার ১ লাখের বান্ডিল ১৫ হাজার টাকা এবং ৫০০ টাকার ১ লাখের বান্ডিল ১০ হাজার টাকা বিক্রি করা হতো।
আজ মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, গতকাল সোমবার (০৩ জানুয়ারি) দিনগত রাতে রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূলহোতা ছগির হোসেনসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র্যাব। এসময় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা সমমানের জাল নোট, ৫টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ১টি সিপিইউ, ৩টি প্রিন্টারসহ জাল নোট তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- ছগির হোসেন, মোছা. সেলিনা আক্তার পাখি এবং রুহুল আমিন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানিয়েছেন, তারা পরষ্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় এই জাল নোট তৈরি করে বিভিন্ন লোকদের কাছে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে আসছিল। চক্রটির মূলহোতা গ্রেপ্তার ছগির হোসেন এবং অন্যান্যরা তার সহযোগী। চক্রের সঙ্গে ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে।
তিনি আরও জানান, হোটেল বয় থেকে জাল টাকা কারবারে জড়ানো ছগির গ্রেপ্তার ছগির হোসেন ১৯৮৭ সালে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে একটি হোটেল বয়ের কাজ নেন। পরবর্তীতে ভ্যানে ফেরি করে গার্মেন্টস পণ্য বিক্রি শুরু করেন। গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির সময়েই ছগিরের সঙ্গে ইদ্রিস নামক এক জাল টাকা কারবারির পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক ও জাল নোট তৈরির হাতেখড়ি হয়। ছগির প্রথমে জাল নোট বিক্রি ও পরবর্তীতে সেসব তৈরির বিষয় রপ্ত করেন। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। বছরখানেক জেল খেটে পুনরায় সে ২০১৮ সাল হতে জাল নোট তৈরি শুরু করেন। তৈরি করা জাল নোটগুলো তার চক্রে থাকা অন্যান্য সহাযোগী রুহুল আমিন, সেলিনা ও অন্যান্য ৭-৮ জনের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিল।
যেখান থেকে জাল টাকার উপকরণ সংগ্রহ করা হতো
মূলহোতা ছগির নিজেই পুরান ঢাকা হতে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি কেনেন। তার ভাড়া বাসায় গোপনে বিশেষ কৌশলে এ-ফোর সাইজের ০২ টি টিস্যু পেপার একসাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রঙ্গিন প্রিন্টারে ডিজাইনকৃত টাকা তৈরি করা হতো। তিনি নিজেই প্রিন্টিং ও কাটিং করতেন। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রিন্টিংয়ের কাজে অন্যান্যদের সম্পৃক্ত করা হতো না। জাল নোট তৈরির পর অন্যান্য সহযোগীদেরকে মোবাইলে কল করে তার কাছ থেকে জাল নোট নিয়ে যেতে বলতেন।
আসল টাকার বিনিময়ে জাল টাকার কারবার
প্রতি ১ লাখ টাকার জাল নোট তৈরিতে ছগিরের খরচ হতো ৫/৬ হাজার টাকা। আর তিনি লাখ টাকার জাল নোট বিক্রি করতেন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে। তার সহযোগিরা মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রি করতেন। টার্গেট বা চাহিদা অনুযায়ী ছগির প্রতিমাসে তার সহযোগীদেরকে বোনাসও দিতেন।
উল্লেখ্য, জাল নোট তৈরিতে যে সকল উপকরন তারা ব্যবহার করে থাকে তার বেশিরভাগ সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজার থেকে। বিশেষ কাগজে তারা প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে এই নোটগুলো তৈরী করে থাকে। আর এই নোটগুলো তারা সেই সকল জায়গায় দিয়ে থাকেন যারা নোট তেমন চিনেন না বা খেয়াল করেন না। তারা ঐ সকল জাল নোট একটি চক্রের মাধ্যমে বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে থাকে। ঐ চক্রটি একটি নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে সেগুলো কিনে নিয়ে থাকে কিংবা অনেক সময় কমিশনের মাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে থাকে বাজারে।