Tuesday , September 17 2024
Breaking News
Home / Countrywide / ১৪ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক সেই মুরাদ হোসেন, পেয়েছেন যেন আলাদিনের চেরাগ

১৪ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক সেই মুরাদ হোসেন, পেয়েছেন যেন আলাদিনের চেরাগ

খুলনার রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন তার ১৪ বছরের কর্মজীবনে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সম্পদের মধ্যে রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গবাদি পশুর খামার, ওষুধের দোকান, বর্জ্যভূমি এবং মাছের ঘের। এলাকার স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান খয়রাতের জন্য তার নাম সবার মুখে মুখে। আত্মীয়স্বজনের নামে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরও তৈরি করেন। সম্প্রতি ভুয়া রপ্তানি দলিলের মাধ্যমে খুলনার তিনটি মৎস্য কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের টাকা ছাড় দেওয়ার অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

রূপালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিমায়িত মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রিয়াম ফিশ এক্সপোর্ট লিমিটেড ও বায়োনিক সি ফুড এক্সপোর্ট লিমিটেড রূপালী ব্যাংক খুলনার শামস ভবন শাখা থেকে জাল কাগজপত্র তৈরি করে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা চুরি করেছে। অভিযুক্ত অপপ্রয়োগের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত এখন চলছে। মুরাদ হোসেন এ শাখায় সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে আত্মসাতের বিষয়টি সামনে এলে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাকির ইবনে বোরাক এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মুরাদ হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার পর মুরাদকে ময়মনসিংহের একটি শাখায় বদলি করা হয়। একই সঙ্গে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক তদন্তও চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এ ঘটনার পর দৈনিক অনুসন্ধানে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। ভুয়া এলসির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি নিয়ে মাছ কোম্পানির প্রতিনিধিরা আগে থেকেই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলত। এরপর কিছু কর্মকর্তা প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ পেতেন এবং অবশিষ্ট অর্থ মাছ কোম্পানিগুলো নিয়ে নিত। ফলে গত কয়েক বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মুরাদ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুরাদের গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার অভয়নগরের সিদ্ধিপাশা ইউনিয়নের নওলি গ্রামে। তিনি ২০০৯ সালে চাকরিতে যোগ দেন। এই ১৪ বছরের কর্মজীবনে তিনি আর্থিকভাবে বেড়ে উঠেছেন। গ্রামে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধ নবনির্মিত দোতলা বাড়ি দেখে যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। বাড়ির উল্টো দিকে পাঁচ একর জমি জুড়ে রয়েছে তার আরও একটি দোতলা বাড়ি। বাড়ির উঠানের দুই-তৃতীয়াংশ প্রধান সড়ক থেকে বেড় করা হয়েছে। চলে গেল পুকুরের ধারে। পুকুরের দুপাশের পাড় ইট দিয়ে সারিবদ্ধ। বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে গরুর খামার। বর্তমানে খামারে কোনো গরু নেই। গত ঈদুল আজহায় এটি বিক্রি হয়েছিল। বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে প্রায় আট বিঘা জমি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে মাছের ঘের। তার নিজের ভাই জাহিদ হোসেন ওই ঘের দেখাশুনা করতেন। সেখানে গিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা এই এলাকায় মাছ চাষ করি। মুরাদ ভাই সবসময় আমাদের সমর্থন করেন। তাঁর আর্থিক সহায়তায় আমি এই ঘেরটি প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি বলেন, আগের বিলে আমাদের আরও ১০ বিঘা জমি রয়েছে। এগুলো ভাই (মুরাদ) কিনেছে। দৌলতপুরে তার বাড়ি ও ফার্ম হাউস এবং ওষুধের ফার্মেসি রয়েছে। তিনি বলেন, আমার ভাই চাকরি পাওয়ার পর আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।

খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর কুলিপাড়ায় মুরাদের বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৫ কাঠা জায়গা জুড়ে চারতলা বাড়ি। বাড়ির সমস্ত ইউনিট ভাড়া দেওয়া হয়। ওই বাড়ির সদর দরজায় বাড়ি ভাড়ার নোটিশ রয়েছে। ওই নম্বরে একজন মহিলা কল রিসিভ করেন। তিনি নিজেকে ব্যাংকার মুরাদ হোসেনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। দৌলতপুরের কাছে আড়ংঘাটা বাইপাস এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে খামারবাড়ি ও বাগান। বাড়ির বাইরের নেমপ্লেটে লেখা আছে মুরাদ হোসেনের নাম। এটি একটি আধুনিক দ্বিতল বাংলো বাড়ি রয়েছে। গরুর খামারে তিনটি বিদেশি জাতের গরু রয়েছে। খামার দেখাশোনার জন্য একজন কর্মচারী রয়েছেন। তিনি জানান, এখানে ৩০টি বিভিন্ন জাতের গরু ছিল। কোরবানির ঈদে এগুলো বিক্রি হয়। এর পাশাপাশি পাশের পুকুরে সাহেবকে (মুরাদ) মাছ চাষের ডাক দেন। ওই জমির মূল্য প্রায় টাকা। এছাড়াও দৌলতপুরে মহসিন মোড়ের ঠিক উপরে ব্যাংকার মুরাদের মালিকানাধীন একটি বড় ওষুধের ফার্মেসি রয়েছে।

এ ছাড়া অভয়নগর উপজেলার সিদ্ধিপাশা এলাকায় যেখানে মুরাদের বাড়ি, সেখানে মুরাদ নিয়মিতভাবে ওই এলাকার ধনী-গরিব সবাইকে সাহায্য করে থাকে। আত্মীয় পরিচয় দিয়ে ইকরাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, মুরাদ ভাই বড় মনের মানুষ। এলাকার কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করে। স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসার ছাদসহ বিভিন্ন উন্নয়নে দেদার অনুদান দেন। এলাকায় তার বেশ সুনাম রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বাবা স্থানীয় একটি কোম্পানিতে নতুন পদে চাকরি করতেন। তারা চার ভাই। তাদের মধ্যে এক ভাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। বাকি দুজন ব্যবসা দেখাশোনা করত। স্থানীয় নওলি বাজারে তাদের বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর ইকরাম বিভিন্নভাবে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।

এসব বিষয়ে জানতে ব্যাংক কর্মকর্তা মুরাদ হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি রিপ্লাই দেননি। যদিও তিনি টেক্সট মেসেজ দেখেছেন।

মুরাদ ২০০৯ সালে রূপালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ১৪ -১৫ বছরের চাকরি জীবনে এত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে এলাকার মানুষও কৌতূহলী।

সিদ্ধিপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কাশেম বলেন, “তার বাবা জুটমিলের একজন কর্মচারী ছিলেন। বছরের পর বছর ধরে মুরাদের পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল। খরচ এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন ছিল। পরে শুনলাম, ব্যাংকের চাকরি ছাড়াও তার আরও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিষয়গুলো পরে খোঁজ নেওয়া হয়নি।

দুদক খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো আমাদের কাছে কোনো তথ্য পাঠায়নি। তবে ওই দুই কর্মকর্তার সম্পদ ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। রূপালী ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. এহতেশামুজ্জামান বলেন, “দুটি মৎস্য কোম্পানির ভুয়া এলসির মাধ্যমে টাকা লোপাটের বিষয়টি জানতে পেরে আমরা তদন্ত করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও পৃথক তদন্ত করছে। সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাকির ইবনে বোরাক এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. এ ঘটনায় মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।আমরা এখন টাকা ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছি।তদন্ত শেষে বোর্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।

About Zahid Hasan

Check Also

হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণের আর পাঁচ দিন, বিপাকে ভারত

আগামী ২০ সেপ্টেম্বর শেষ হতে চলেছে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ। বর্তমানে, কূটনৈতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *