বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এমন একটি স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে জনগণই অনেকটা বিভ্রান্তিতে পড়েছে এটা ভেবে যে, কোন সরকার সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবে? সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য অসহনীয়ভাবে বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবন যাপনে ভোগান্তি- সব মিলিয়ে একটি ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে দেশের পরিস্থিতি। তবে সরকারের পতন ঘটলেও ক্ষমতায় বা সরকারে যে দল আসবে তারা জনগণকে কতটা সুবিধা দিতে পারবে সে বিষয়েও অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ আমান প্রকাশ্যে সরকার উৎখাতের হুমকি দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর অন্য কারো কথায় নয়, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায় দেশ চলবে। তার বক্তব্যকে দেশবিরোধী ও অজ্ঞতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন এই বক্তব্য উ’/স্কানিমূলক। এটি সহিং/’সতার ইঙ্গিত দেয়,২০১৪ এবং ২০১৫ এর কথা মনে করিয়ে দেয়।
এর আগে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালকে নিয়ে বিষোদ্গার করে সমালোচনার মুখে পড়েন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তার বক্তব্যকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ‘আক্র/”মনাত্মক, সংবেদনশীল, অশালীন এবং কুৎসিত’ বলে বর্ণনা করেছেন।
গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয়তাবাদী উলামা পার্টির ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমান বলেন, ‘প্রস্তুত হন, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কাঁচপুর সেতু, টঙ্গি ব্রিজ, মাওয়া সড়ক, আরিচা সড়ক, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়াসহ পুরো দেশ বন্ধ করে দেয়া হবে।’
রাজপথে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত ৫০ জন রক্ত দিয়েছেন। মৃ”ত্যুর আগে তারা বলে গেছেন, আমাদের রক্তের ঋণ তখনই শোধ হবে যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে, যখন জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পাঁচজন কেন, যদি পাঁচ হাজার মানুষকেও শহীদ হতে হয়, তাহলে এদেশে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। প্রয়োজনে আমরা শহীদ হব, কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এই সরকারের বিদায় ঘটিয়ে আমরা ঘরে ফিরব।’
শুধু আমানই নয়, দলের মধ্যবর্তী কয়েকজন নেতাও এমন বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ৯ অক্টোবর দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী জানান, শিগগিরই দেশে আসবেন তারেক রহমান। পরদিন দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে ‘আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো। এই সমাবেশে যাবেন খালেদা জিয়া।
সরকার পতন নিয়ে একই বক্তব্য দিচ্ছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। প্রায় প্রতিটি সভায় তিনি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের কথা বলেন। যেখানে তিনি সর্বদা নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। দলের অন্য নেতারাও সবাইকে ‘লাঠি’ নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলছেন।
১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। এদিনের কথা উল্লেখ করে আমানের বক্তব্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই বিএনপির রাজনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ নিয়ে বিএনপির ভেতরে-বাইরে সমালোচনা হচ্ছে।
এ ধরনের বক্তব্য আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করছেন দলের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা। এমনকি বিএনপির প্রতি ইতিবাচক দলগুলোও মনে করে এসব বক্তব্য বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় না। এ বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র ফোরামের নেতা সাইফুল হক বলেন, এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় বক্তব্য বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করে। আন্দোলনে বিভাজন হতে পারে।
আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি নেতারা হয়তো স্বপ্ন দেখছেন। না হলে এমন কথা বলতে পারেন না।
এদিকে এতিমদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রে/”নেড হামলার পরিকল্পনা এবং শেখ হাসিনাকে গুপ্তহ’/”ত্যার চেষ্টার জন্য তারেক রহমানকে সাজা দেন আদালত। বর্তমানে তিনি লন্ডনে পলাতক রয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হলো সাজা হওয়ার পরও তারা কীভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে?
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ৩ নভেম্বর, ২০০৮ তারিখে, তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে একটি গোপন তারবার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে লিখেছিলেন, “তারেক রহমান ব্যাপক দুর্নীতির জন্য দায়ী, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলছে। …”
এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়ায় দুর্নীতির মামলা রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আর তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, আমান উল্লাহ আমান যদি দেশ পরিচালনার উল্টো স্বপ্ন দেখে থাকেন, তাহলে সরকারকে ভাবতে হবে, খালেদা জিয়ার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদারতা দেখিয়েছেন তা আদৌ প্রয়োজন কি না, নাকি তাকে আবার জেলে পাঠাতে হবে।”
গত এক যুগে মাঠের যোগ্যতা পর্যালোচনা না করে একাধিকবার হ”রতাল ডেকেছে বিএনপি। এরপর দলীয় নেতাকর্মীরা ঘরে অবস্থান করায় নেতাকর্মীরাও রাস্তায় নামেননি। কখনো কখনো সাত-আটজন মিছিল নিয়ে নেমে পড়েন রাজধানীর অলিগলিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। হরতাল ডাকার পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতি দেখা যায়। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, হরতাল ডেকে ঘরে বসেছিলেন বিএনপি নেতারা।
তবে মানুষের মধ্যে ভী’তি ছড়াতে গাড়িতে আ’গুন দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি তারা। সব মিলিয়ে হরতাল দলের জন্য বুমেরাং হয়েছে। বাংলাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন হরতাল-ভিত্তিক সহিং”/সতা ও ধ্বং”সযজ্ঞ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
আমান ঘোষণার পরের সেই দিনগুলোর কথা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। হারুন-অর-রশিদ বলেন, এটি একটি অজ্ঞতাপূর্ণ বক্তব্য। এই ধরনের বিবৃতি উস্কানিমূলক, যা ২০১৪ এবং ২০১৫-এর মতো সহিং”সতার প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। একজন রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে এই ধরনের অশ্লী”ল বক্তব্য অপ্রত্যাশিত।
তিনি বলেন, “বিগত দিনে বিএনপি নেতাদের অনেকেই এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তা বাস্তবের আলো দেখেনি। তাদের বক্তব্যে নৈরাজ্যের বার্তা রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, “আমান দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েছেন, যা বিএনপির অনেক নেতাই মানছেন না। আমানউল্লাহ আমান একজন সাধারণ কর্মী নন। তিনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। একজন সিনিয়র নেতা। নেতা, মন্ত্রীও ছিলেন, ডাকসুর ভিপি ছিলেন, কথা বলার ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
তার মতে, এটা দলীয় সিদ্ধান্ত নয় বলে মনে করেন বিএনপির অনেকেই। এ ধরনের মন্তব্য একেবারেই দেশবিরোধী। কারণ দেশ চলে দেশের সংবিধান অনুযায়ী, কারো কথায় নয়। এসব বলার অর্থ রাজনৈতিক মাঠ গরম করা, কর্মীদের শক্তিশালী করা।
এরই মধ্যে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বিএনপি। দলটি চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহেও গণসভা করেছে। হাছান মাহমুদ বলেছেন, চট্টগ্রামে ‘ব্যর্থ সমাবেশ’ করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে বিএনপি।
তিনি বলেন, তিন মাস পর মহাসম্ভবের নামে ‘ফ্লপ’ সমাবেশ করেছে বিএনপি। সারাদেশ থেকে স”ন্ত্রাসীদের চট্টগ্রামে এনে হোটেল ভাড়া করা হয়। পরদিন তারা সমাবেশ করেন। চট্টগ্রামে জব্বার বলী খেলায় এর চেয়েও বেশি মানুষ হয়ে থাকে। এই সমাবেশে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
এরই মধ্যে প্রায় ২০টি জেলায় বিক্ষো”ভ-সমাবেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘ’/’র্ষের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। আহতের পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
বিএনপি নেতাদের কথায় সরকারের পতন হবে না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিএনপির মহাসচিব তার দলের মোহভঙ্গ নেতা-কর্মীদের উল্লাস করতেই এমন কথা বলে আসছেন। এটা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য।
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি ১৪ বছর ধরে গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলনের ভয় দেখাচ্ছে। তাদের তর্জন-গর্জন মিডিয়া এবং ফেস”বুকে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ এটা ভালো করেই জানে। বাস্তবের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আসলে দেশে গণঅভ্যুত্থানের মতো পরিস্থিতি নেই।
বিএনপি নেতাদের মতে, তৃণমূলের কর্মীরা খুব একটা আশাবাদী নন। শীর্ষ নেতৃত্বের অনড় সিদ্ধান্তের কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আগের জৌলুস হারিয়ে ফেলেছেন। গাইবান্ধরের গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের পর নেতারা আন্দোলনের খবর রাখেন না। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কারণে শ্রমিকদের ওপর নির্যা/”তন-নিপী”ড়ন বেড়ে যায়। অনেককে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হয়। সরকারের ওপরও কোনো চাপ তৈরি হয় না।
এদিকে বিএনপি’র যে সমস্ত তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী রয়েছে, তাদের একটি অংশ মনে করছেন, যে সকল নেতাকর্মীরা আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে দলের পদ-পদবির লোভেই বা নিজেদের পদ ধরে রাখতে কিংবা সামনে ভাল কোন পদ পাবেন, এমন আশা করেই সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। তবে বিএনপি’র অবস্থা পারতপক্ষে অনেকটাই দুর্বল। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন সময় এসে পড়েছে যখন দেশের পরিস্থিতি অনেকটা বেকায়দায় এসে পড়েছে, যেটা ক্ষমতাসীন দল আ.লীগের জন্য দু:সময়।