Friday , September 20 2024
Breaking News
Home / Exclusive / হেফাজতের ভাষ্কর্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন একটি সাংবিধানিক অধিকার: পিবিআই প্রতিবেদন

হেফাজতের ভাষ্কর্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন একটি সাংবিধানিক অধিকার: পিবিআই প্রতিবেদন

২০২১ সালের এপ্রিল মাসের দিকে ঢাকার ধোলাই পাড় এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য যদি নির্মাণ করা হয় তাহলে সেটাকে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার হুমকি দেয় কওমি আলেম নূর হোসাইন নূরানী, এমনটাই জানা যায়। সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা সমালোচনা। এরপর তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয় এবং সেই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। জানা গেছে নূরানী হেফাজতের প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। একসময় একটি সমাবেশের মাধ্যমে এমন ধরনের হুমকি দেয়া হয় যে ভাস্কর্য নির্মাণ নির্মিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু হবে।

এদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় নি’ক্ষেপের মতো বি’/দ্বেষমূলক বক্তব্যকে অভিমত ও সাংবিধানিক অধিকার – এই বিষয়ের ওপর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে দাখিল করা একটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাবি করেছে। প্রতিবেদন জুড়ে সা”ম্প্রদা/য়িক বার্তা ও রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে। এমনকি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে, সমালোচকরা এমনটিই বলেছেন। মামলার বাদী ইতিমধ্যে এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের নারাজি দিয়েছেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত করছে।

মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ২০২০ সালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন, হা/’মলা, বি”দ্বেষ ছড়ানো ও সা’ম্প্রদা/য়িক উশ/’কানির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র’দ্রোহের মামলা করেন। মামলায় হেফাজত ইসলাম নেতা মামুনুল হক, চরমোনাই পীর সৈয়দ ফয়জুল করিম ও হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীকে আসামি করা হয়।

মামলায় আমিনুল ইসলাম বুলবুল অভিযোগ করেন, ‘এই তিন ব্যক্তি তাদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিদ্বে’ষ ছড়িয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অপ”রাধ।

আদালতে দায়ের করা মামলায় তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর মামুনুল হক তোপখানা রোডে বসে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যে বলেন, যারা ভাস্কর্যের নামে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন করেছে, তারা বঙ্গবন্ধুর সন্তান হতে পারে না, এই মূর্তি স্থাপন করা বন্ধ করুন। আমাদের অনুরোধ মানা না হলে তৌহিদী জনতা নিয়ে আবারও শাপলা চত্বর প্রতিষ্ঠা করা হবে।” এসব বক্তব্য তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফে’/সবুক ও ই’/উটি’উবে ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বি’/দ্বে”ষ ছড়ান। রাষ্ট্র ও সরকার উৎখাতের ষড়য”ন্ত্রে তিনি জড়িত থাকায় এটা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।

একই মামলায় তিনি চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফয়জুল করিমকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর যাত্রাবাড়ীর গেন্ডারিয়া এলাকায় এক জনসভায় ফয়জুল করিম হাত তুলে শপথ নেন। তিনি শপথ করেছিলেন, “আমি প্রতিবাদ করব, আমি লড়াই করব, আমি রক্ত ​​দিতে চাই না, আমি একবার দেওয়া শুরু করলে আমি থামব না।” রাশিয়ার লেলিনের ৭২ ফুটের ভাষ্কর্যটি যদি ক্রেন দিয়ে তুলে সাগরে ফেলে দেওয়া যায়, তবে আমার মনে হয় শেখ শাহের মূর্তিটি তুলে নিয়ে আজ না কাল বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে।” এই শপথ নিয়ে তিনি অসম্মান করেন। বাঙালি জাতির পিতা এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বৈধ সরকারের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞা সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখযোগ্য স্মৃতি।

জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে মামলায় ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জনসভায় বাবুনগরী বলেন, মদিনা সনদে দেশ চলে তাহলে ভাস্কর্য থাকতে পারে না। তিনি সরকারকে হুঁশি”য়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে না গেলে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা তৈরি করে ভাস্কর্য নিক্ষেপ করবেন।

মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে। পুলিশের এই তদন্ত সংস্থা মামলার তদন্ত শেষ করে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোঃ তৈয়বুর রহমান মামলার আসামিদের বেকসুর খালাস করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তিনজনকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের তথ্য সংগ্রহের পর তিনি কিছু মূল্যায়ন দেন। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে প্রতিবাদ ও মন্তব্য করা সাংবিধানিক অধিকার।’

তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ট্র্যাজেডি বর্ণনা করে লিখেছেন, “এই বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমানের ধ”র্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধ”র্মীয় জ্ঞানের দিক থেকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং একটি শক্তিশালী সামাজিক অবস্থান রয়েছে।” কোরআন-হাদিসের আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপদেশ দিয়ে তারা ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচিত হয়েছেন। ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়ে তিন আসামি (মামুনুল হক, সৈয়দ ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবুনগরী) যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের প্রত্যেকেই একটি ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ধর্মপ্রাণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে তাদের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।

তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘তাদের বক্তব্যে সংবিধান বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তাদের বক্তব্যে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসন্তোষজনক মতামত প্রকাশ করা হয়। আর তারা এ মতকে কুরআন-হাদিসের আলোকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম দেশের জনমনে উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীন দেশে কোনো সরকারি কর্মকাণ্ড বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা যদি গণবিরোধী, স্বার্থবিরোধী, জা”ত-পাত-বিরোধী এবং ধ’র্মবিরো/ধী হয়, তাহলে প্রতিটি নাগরিক সেসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করতে পারে। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তাই ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে তাদের ভাষ্কর্য স্থাপনের কাজ রাষ্ট্রদ্রোহের আওতাভুক্ত নয়। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে ঘোষণার মাধ্যমে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধের অনুরোধ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম নেতা ছিলেন। তার ভাষ্কর্য স্থাপন করা হলে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর আত্মা বা রুহকে এই ভাস্কর্যের জন্য সর্বশক্তিমান রাব্বুল আল আমিনের সামনে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুসলিম বিশ্বের কাছে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারাসহ দেশের বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিতরা ধর্মের প্রশ্নে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ করেছেন। তাই তাদের এই কাজ রাষ্ট্রদ্রো”হিতার অপরাধে কিছু যায় আসে না।

চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘মামুনুল হক, ফয়জুল করিম ও জুনায়েদ বাবু নাগরী, ব্যক্তি ও দল যদি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘ”ন করে কোনো কর্মকাণ্ডে সরকারকে অমান্য করে বা দেশের জনগণকে সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উশকে দেয়। তাদের নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, রাজ্যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা। সৃষ্টির জন্য জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া রাষ্ট্রদ্রো”হের অপরাধের আওতায় আসে। কিন্তু এ মামলায় তাদের তিনজনের দেওয়া জবানবন্দিতে এ ধরনের কোনো তথ্য ও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতির করা অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়নি, সে কারণেই তারা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে খালাস পান।

বিষয়টি বাদী আমিনুল ইসলাম বুলবুলকেও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বুলবুলকে প্রশ্ন করা হলে তিনি দেশের একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমরা ইতিমধ্যে পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে আপত্তি জানিয়েছি।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পুরো বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে লেখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার একক সিদ্ধান্তে এখানে কিছুই হয়নি। তিনি আরও বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য করতে এ ধরনের বক্তব্য লেখা হয়েছে।

এদিকে এমন অভিযোগপত্রের সমালোচনা করেছেন অনেকে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে কলামিস্ট শাওন মাহমুদ এ ধরনের সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ও রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘হেফাজত নামের এই সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ। পুলিশ হয়ত অনুসরণ করেছে। হেফাজত নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য কখনো সাংবিধানিক অধিকার হতে পারে না। পিবিআই তাদের প্রতিবেদনেও এ কথা বলতে পারে না। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের মূলনীতি। কিন্তু ৫০ বছর পরও আমাদের দেখতে হবে। ৩ মিলিয়ন মানুষ এর জন্য প্রাণ দেয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. তৈয়বুর রহমান বলেন, “তদন্তে আমরা যা পেয়েছি, সে অনুযায়ী আমরা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। এখন এ বিষয়ে কী হবে তা আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের তদন্তে বাদীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। পিবিআই একটি বোর্ড গঠন করেছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রমাণের জন্য যে তিনটি উপাদান ( বি’/দ্বেষ ও শ”ত্রুতা) প্রয়োজন তা পাওয়া যায়নি।

মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগ তদন্ত করছে। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা গত এপ্রিলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। আমরা এখনও তদন্ত করছি। তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে আদালতকে জানানো হবে।

উল্লেখ্য, নূরানী সমাবেশে ঘোষণা দেওয়ার পর যদি ভাস্কর্য নির্মাণ হয় তাহলে কঠোর আন্দোলনে নামবে সমাবেশ থেকে এমন ধরনের হুমকি দেয়ার পর সরকারপন্থিরা মাঠে নামে। এমনকি সেসময় যারা বিচারক তারাও মাঠে নামেন এবং জাতির পিতার সম্মান রক্ষার দাবি জানান। তবে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে এমন সম্ভাবনায় সরকার পিছু হটে। একসময় কওয়ামীপন্থীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে নিয়ে আর তেমন কিছুই হয়নি। তবে সেই ভাস্কর্যটি অবশ্য এখনও নির্মিত হয়নি বলেও জানা গেছে।

About bisso Jit

Check Also

চুলের মুঠি ধরে নারী চিকিৎসককে রোগীর মারধর (ভিডিও সহ)

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আরজি কর হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসককে হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *