হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি একটি সময়। চিকিৎসকরা সেই সময় জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমার জীবনের আয়ু আর বড়জোর রয়েছে সাত মাস। আমি এটার শোনার পর কিছুটা হতাশ হলেও বিশ্বাস করিনি. আমি এখনও লড়াই করে বেঁচে আছি। তাই রোগী হয়েই বিছানায় শুয়ে লিখছি। আমি রোগশয্যায় থাকাকালীন পৃথিবীতে অনেক অনেক বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ ও আমেরিকার সম্পর্কের বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি বরং কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের একটি বিশেষ ফোর্স র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তার প্রতিবাদ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রেও যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তার বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমার ধারনা, আলোচনা করা একটি ব্যর্থ চেষ্টা, যেটা নিয়ে কোনো ফলপ্রসূতা আসবে না। আমেরিকা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে তাদের বশীভূত করতে চায়।
সম্প্রতি ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান মিলে যে স্কোয়াড গঠন করা হয়েছে তাতে আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশকে ঢুকতে হবে। নইলে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হবে না। এটা অনেকটা পঞ্চাশের দশকের মার্কিন সা’মরিক চুক্তিগুলোর মতো। পাকিস্তানকে বাগদাদ চুক্তি নামের আমেরিকার সা’মরিক চুক্তিতে ঢুকতে বাধ্য করা হয়েছিল। তার পরিণাম আজ পাকিস্তান ভুগছে। তার অবস্থা এখন ‘না ঘরকা না ঘাটকা’।
বাংলাদেশে এখন চীনের প্রচুর অর্থনৈতিক লগ্নি হচ্ছে। এটা বন্ধ হলে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আশা করে, চীনের সাহায্যে গভীর সমুদ্রে নৌবন্দর নির্মাণ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক উন্নতি ঘটাবে। আমেরিকা চায় না বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাক। সুতরাং বাংলাদেশের ওপর নানা রকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। আসল চাপটা ভারতের। চীনের অথনৈতিক শত্রু ভারত। এখন আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চীনের রাজনৈতিক শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশকে ভারত সরাসরি চাপ দিতে পারছে না। তাই আমেরিকার সাহায্যে এই চাপ প্রদান। ভারতের অভ্যন্তরে নানা বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দমন-পীড়ন একটি প্রধান ইস্যু। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মনে ক্ষোভ আছে। এটা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে। হাসিনা ও মোদি পরস্পর বন্ধু। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু ভারতে মোদির আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব দম’ন-পী’ড়ন চলছে তাতে শেখ হাসিনা ক্ষু’ব্ধ। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যে সাহায্য করেছে তা স্মরণ করে বাংলাদেশ ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। তবে এই কৃতজ্ঞতার পাশ কাটিয়ে কী করে মোদি সরকারকে অসাম্প্রদায়িকতার পথে টেনে আনা যায় শেখ হাসিনা তাও ভেবে দেখছেন। কিন্তু টেনে আনতে পারছেন না। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কের চিড় ধরতে পারে এমন আশ’ঙ্কা রয়েছে।
পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা বিভিন্ন সামরিক জোট গঠন করে তাতে বিভিন্ন দেশকে টেনে এনে বিশ্বে আধিপত্য করতে চেষ্টা করেছিল। এ ব্যাপারে নেহরুর ভারত ছিল সম্পূর্ণ অটল যে তারা কোনো জোটে যোগদান করবে না।
ভারতের এই নিরপেক্ষতার নীতি তখন সর্বত্র বিশেষ করে আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোতে প্রশংসিত হয়েছিল। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় পরাশক্তি ছিল। এই দুই পরাশক্তির মধ্যে চলছিল শক্তির পরীক্ষা। ভারতের অনুসরণে পৃথিবীর প্রায় ৭৩টি দেশ মিলে গঠন করে জোটনিরপেক্ষ আ’ন্দোলন বা ন্যাম। এই সময় আমেরিকা নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশকে তার সাম’রিক জোটে যোগ দিতে বাধ্য করে। ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমেরিকার এই কৌশল অনেকটা ব্যর্থ হয়। ন্যাম অত্যন্ত শক্তিশালী হয়। তাতে তখন নেতৃত্ব দিয়েছেন নেহরু, এনক্রুমা, নাসের, টিটো প্রমুখ শক্তিশালী নেতা। নাসের ও নেহরুর মৃত্যুর পর এই সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। রুশ-মার্কিন জোটের শক্তি পরীক্ষার সময় চীন আমেরিকার জোটে যোগ না দিতে গেলেও আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সহযোগিতা গড়ে তোলে। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে তার একটা ছোটখাটো যু’দ্ধও হয়।
আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য করে চীন ব্যাপকভাবে লাভবান হয় এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চীনের এই শক্তি অর্জন আমেরিকা ও ভারত দুইয়েরই চক্ষুশূল হয়। নরেন্দ্র মোদি ভারতে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। চীনও সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমেরিকা ও ইসরায়েলের বন্ধুত্ব এই পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ভারত ও চীনের মৈত্রী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শত্রুতা বেড়ে যায়। এ সমস্যার মুখে শেখ হাসিনা ভারত, চীন ও আমেরিকা এই তিন শক্তিকেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বর্তমান ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থাকতে চায়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও আবার সে কথা বলেছেন। তা সত্ত্বেও আমেরিকা তাদের গণতন্ত্র সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই সমস্যায় পড়েছিলেন; তিনি কি যু’দ্ধবিধ্ব’স্ত বাংলাদেশকে পুনর্নির্মাণের জন্য আমেরিকা অথবা রাশিয়ান শক্তি জোটে যোগ দেবেন? সেই দুর্দিনেও বঙ্গবন্ধু কোনো শক্তিজোটে যোগ না দিয়ে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে মিত্রতা সত্ত্বেও তিনি চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য। কিউবার মাধ্যমে চীনকে পাট পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
আজ চীন ও মার্কিন শক্তি জোটের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও তার বাবার আদর্শ গ্রহণ করেছেন। ভারত আমাদের প্রতিবেশী এবং বন্ধুত্বপূর্ন দেশ, চীনও আমাদের একটি বন্ধু প্রতীম দেশ। এই দুই দেশের সাথেই সমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে বাংলাদেশ। আমেরিকান ডেমোক্রেসি কনফারেন্সে আমন্ত্রণ পাওয়া এবং সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র্যাব কর্মকর্তাদের সফরের যে বাধা রয়েছে সেটা দূর করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অবশ্যই তাদের নিকট নিকট নতি শিকার করার মাধ্যমে না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে তাতে তার রাজনৈতিক দর কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশ কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। এটাই তো আমরা দেখতে চাই, তাই নয় কি?