সময়টা ২রা ডিসেম্বরের মধ্যরাত। বেপরোয়া গতিতে আসা একটি BMW গাড়ি সিগন্যালে দাঁড় করিয়ে রাখা একটি মোটরসাইকেলকে প্রচন্ড গতি নিয়ে ধাক্কা দেয়। একজন বিচারকের ছেলে ঐ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন বলে অভিযোগ। মনোরঞ্জন হাজং নামের এক ব্যক্তি ঐ মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন। তিনি বিজিবি হাবিলদার থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজের আয় চালু রাখার জন্য একটি বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিতে সামান্য বেতনে সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বেপরোয়া গতির গাড়ির ঐ দূর্ঘটনায় পড়ে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সময় দুই ধাপের অপারেশন করা হয়েছিল যাতে তার একটি পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। এখন সেটাও তাকে সুস্থতা এনে দিতে পারছে না, উরু পর্যন্ত কাটতে হবে, কিন্তু তৃতীয় ধাপে যে অপারেশনটি করা হবে যেদিন তার আগের দিন তার হার্ট অ্যাটাক হয় যার কারনে তা আর করা যায়নি। বলা যায়, বর্তমানে তার জীবন এখন পড়েছে সংকটের মুখে।
ঢাকার রাস্তায় প্রভাবশালীদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো নতুন কিছু নয়। দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি, প্রভাবশালী ধনী পরিবারের ছোট ছেলেমেয়ে, বেশির ভাগই নে’/শাগ্রস্ত, ঢাকার রাস্তায় কার রেসিং বা গাড়ি রেসিং ছাড়া দ্রুত গতিতে চালানো এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার, দেখা যায় হার হামেশাই। এসব ঘটনায় হ’তা’হতের ঘটনাও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দফা হ’তাহ’তের পরও থামেনি প্রভাবশালীদের বেপরোয়া গতি।
হয়তোবা প্রভাবশালী বলেই কোনও ঘটনার বিচার আজ পর্যন্ত হয়েছে বলেও শোনা যায়নি। আর বিচার হয়নি বলেই থামানো যায়নি তাদের বেপরোয়া গতির গাড়ি চালানো।
একজন বিচারপতির ছেলে বিএমডাব্লিউ কেন, ল্যাম্বরঘিনি/বুগাত্তিও চালাতে পারেন। হতেই পারে তার পুত্র বিরাট কোনও ব্যবসা করে, কিংবা বিচারপতির নিজের কোনও ব্যবসা আছে। হতেও পারে তিনি পৈত্রিক কিংবা বৈবাহিক সূত্রে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো দেশটি বাংলাদেশ। এখানে স্বাস্থ্য বিভাগের এক ড্রাইভার কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ঘর ঘাঁটলে শত কোটি টাকার সম্পত্তির কাগজ পাওয়া যায়। তাই এক ধরনের আস্থাহীনতা এখন সবকিছুতেই। আছে প্রশ্ন, আছে অবিশ্বাস। আর সে কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এই দামী গাড়িটির টাকার উৎস নিয়েও।
প্রশ্ন যেহেতু উঠেই গেছে, ভালো হতো যদি বিচারপতি মহোদয় নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তার আয়কর ফাইল প্রকাশ করতেন। ভালো হতো যদি দেশে যে একটি তথাকথিত দুর্নীতি দমন কমিশন আছে তারা এখন অন্তত এটা নিয়ে কাজ করে মানুষের সামনে সত্য প্রকাশ করতো। এমনকি উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন আলোচনা যেহেতু সমাজে উঠে গেছে, তাই উচ্চ আদালতের পক্ষ থেকেও এই ব্যাপারে মানুষের কাছে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু এটা বাংলাদেশ, তাই এসব ‘ভালো হতো’ কেবল কথার কথাই হয়ে থাকে, বাস্তবে আর রূপ নেয় না।
জনাব মনোরঞ্জন হাজং-এর দুর্ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর বিষয়টি মিডিয়ার সামনে আসে। এটা যে মিডিয়ার সামনে আসতে পারলো এবং কিছুটা চাঞ্চল্য তৈরি করতে পারলো, সেটা হলো তার মেয়ে মহুয়া হাজং এর কারণে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে দুর্দান্ত সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মহুয়া জানিয়েছেন ভ’য়াব’হ সব তথ্য। একটি পত্রিকাকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ঘটনার ভিডিও ফুটেজ আছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় ন্যায়-বিচার পাচ্ছি না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আকার-ইঙ্গিতে মামলা করে কোনও লাভ হবে না বলে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।’
মহুয়া হাজং আরও বলেন, ‘এজাহার কয়েকবার পাল্টাতে হয়েছে। অভিযুক্তদের নাম কে’টে অজ্ঞাতনামা লিখতে হয়েছে। অভিযুক্তদের নামসহ এজাহার দেখে থানার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, আমার বয়স কম, তাই ঘটনা বুঝতে পারছি না। তাঁরা আমাকে এজাহার লেখা শিখিয়েছেন। ১১ ডিসেম্বর এজাহারে অভিযুক্তদের নাম বাদ দিয়ে অজ্ঞাতনামা লেখার পর থানায় এজাহার রেখে আসতে বলেছেন। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে থানা থেকে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।’ পুলিশ মামলা নিচ্ছে না, এমনকি গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে তাকে। হাসপাতালের মধ্যেই বসানো হয়েছে পুলিশি পাহারা। এসবের সাথে আছে বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের নানামুখী চাপ।
এই মামলা না নেওয়া নিয়ে প্রায় সব গণমাধ্যমের মূল সুর হচ্ছে ‘এমনকি নিজেদের সহকর্মীর মামলা নিচ্ছে না পুলিশ’। বর্তমান বাংলাদেশের এ যেন এক ভিন্নধর্মী প্রতিচ্ছবি। দেশের সাধারণ নাগরিকরা এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছে সন্তোষজনক সেবা পাবার দূরাশা ছেড়েছে বহুকাল হলো। কিন্তু নিজেদের এক সহকর্মীকেও তারা সাহায্য করছে না, সেটা আমাদের মিডিয়ার কাছে অন্তত অভিনব বলে মনে হয়েছে। প্রত্যাশিতভাবেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন তাদের প্রত্যেকেই। কেউ বলছেন জানেন না, আবার কেউ এড়িয়ে গেছেন সাড়া না দিয়ে।
বাবাকে নিয়ে এভাবে সরব হয়ে মহুয়া সত্যিই ভীষণ ঝুঁকি নিয়েছেন। তিনি নিজে বোঝেনও সেটা। তিনি জানান, তাঁর চাকরির বয়স মাত্র তিন বছর। বাবার মামলা নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলে তোপের মুখে আছেন তিনি। ভবিষ্যতে চাকরিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। তিনি আরও জানান, ‘অভিযুক্তের পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার খরচসহ অন্যান্য সহায়তা করার মাধ্যমে আপসের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি কোনও পরিস্থিতিতেই আপস করব না।’ কোনও পরিস্থিতিতেই আপস না করার এই দৃঢ় অঙ্গীকারই গড়পরতা আর সব ঘটনা থেকে আলাদা করেছে তাকে।
মহুয়া একজন তরুণ পুলিশ অফিসার। দেশের পরিস্থিতিইবা বুঝেছে কতটা আর মাত্র তিন বছরের চাকরি জীবনে কতটাইবা বুঝেছে নিজ বাহি’নীকে। বাবার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়া, সাথে আবার চিকিৎসার খরচের বিরাট বোঝা তাকে দিশেহারা করে দিতেই পারে। অনুমান করি জলে থেকে ‘কুমির’ এর সাথে বিবাদে তিনি খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারবেন না। তবে খুব চাই, মহুয়া তার এই লড়াই চালিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি যদি শেষ পর্যন্ত সেটা না পেরেও থাকেন, তবুও এখন পর্যন্ত যতটুকু সাহস দেখিয়েছেন তিনি, তাতেই তাকে অন্তরের গভীর থেকে স্যালুট জানাই রাষ্ট্রের কদর্যতার এই বিষয়টি সামনে আনার জন্য।
‘এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার’, ‘এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ এসব বলে নানা বিব্রতকর ঘটনা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা হচ্ছে বর্তমান সময়ে। রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শাসন এবং বিচার বিভাগ জড়িত হয়ে পড়েছে এই ঘটনায়। অন্তত উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি প্রশাসনে অন্যায় প্রভাব খাটাচ্ছেন আবার প্রশাসন কারো অন্যায় প্রভাবে থেকে কাজ করছেন- বিষয়টিকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে চালিয়ে দেওয়া কি সম্ভব?
এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের বিচার বিভাগের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের এমন আচরণ কি পুরো বিভাগের ওপরে আস্থার সংকট তৈরি করে না? তাহলে বিচার বিভাগের কি এটা নিয়ে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়? একজন বিচারপতির দায় নিয়ে পুরো বিভাগ কেন মানুষের আস্থাভঙ্গের ঝুঁকি নেবে?
লেখাটি লেখার সময় নিউজ ফিডে দেখতে পেলাম ১৪ দিন পরে অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মামলা নিয়েছে, যদিও ঐ মামলাটিতে কোনো আসামির নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নাম দিয়ে মামলা নিয়েছে পুলিশ। ফৌজদারি মামলায় সময়ের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ন। ১৪ দিনের বিলম্বের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে মামলা নিতে পুলিশ যে অনীহা দেখিয়েছে সেটা কখনো লেখা হবে না বলে জানি। আমি মনে করি মূলধারার মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া মামলার পিছনে আলোড়ন সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা পালন করেছে। দেশের মানবাধিকার ও সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর একটি জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) মামলা দায়েরের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ এদেশে ন্যায়বিচার শুরুর একটি শর্ত পূরণ হয়েছে। মামলাটি ‘চাঞ্চল্যকর’ হওয়ায় প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট না দেওয়াও এদেশে বিচারিক প্রক্রিয়ায় এগোনোর মতো মামলা রয়েছে।
ঢোল পিটিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছি মাত্র। কিন্তু তার শুরুতেই এই ঘটনা আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে আমরা যে উচ্চবাচ্য করি সেটা আমাদের স্বাধীন এই দেশে অনেক দূরস্থান, আমাদের দেশ এখনও আধুনিক কোনো রাস্ট্র হিসেবে হয়ে উঠতে পারেনি।
রুমিন ফারহানা, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।