আবরার ফাহাদ, বাংলাদেশের আলোচিত একটি নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে বুয়েটের প্রয়াত এই ছাত্রের নামটি। নিজের দেশের স্বার্থের কথা বলে তাকে ছাত্রলীগের কাছে দিতে হয়েছিল তার জীবন। আর সেই থেকেই আবরার ফাহাদ দেশের সব থেকে জনপ্রিয় একটি নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দিকে গেলো কয়েকদিন আগে এবারের ফাহাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। দেখতে দেখতে চলে গেছে তিনটি বছর। এবার এ নিয়ে একটি বিশেষ লেখনী লিখেছেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু:-
দেখতে দেখতে পার হলো তিন বছর। আমাদের কাছে তিন বছর যেন চোখের পলকে শেষ। কিন্তু যে মা তার ছেলেকে হারিয়েছে, স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে যে মায়ের সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে তারই সহপাঠীরা, যে মা সন্তানকে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে ফেরত পেয়েছে ছেলের লাশ, সেই মায়ের তিন বছর পার হয় কী করে?
সেই মা কি পারে ঘুমাতে? প্রতি রাতে ঘুম থেকে উঠে ভাবেন- ঠিক কীভাবে মারা গেল তার সন্তান? কতটা আঘাত সইতে হয়েছে তাকে কেবল মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য? শেষবেলায় কী বলেছিল সে? মাকে ডেকেছিল কি? একবার দেখবে বলে খুঁজেছিল কি মাকে? শেষ সময়ে মমতার কোনও স্পর্শ পেয়েছিল কি ছেলেটা? প্রশ্ন, প্রশ্ন আর প্রশ্ন কেবল। মাথায় ঘোরে, দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে বারবার, নিরুত্তর।
শুধু সাম্প্রতিক ইতিহাসেই নয়, ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হ’ত্যা’র’ মতো নৃশংস ঘটনা অন্যতম নৃশংস অপরাধ হিসেবে আলোচিত হবে। ফেসবুক স্ট্যাটাসের ‘অপরাধে’ একই প্রতিষ্ঠানের অন্য ছাত্রদের হাতে ‘খু’ন হয়েছেন মেধাবী যুবক। কাউকে দীর্ঘক্ষণ পিটিয়ে মৃ’ত্যু’ নিশ্চিত করা একেবারেই অন্যরকম। এর জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ধরনের মন। তাই আবরার হ’ত্যা’র’ এই নৃশংসতা আমাদের সবাইকে আহত করেছে, স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ করেছে।
কয়েকদিন আগে বুয়েট ছাত্র আবরার হ’ত্যা’র’ তিন বছর পর শুক্রবার বিকেলে ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের ব্যানারে স্মরণ সভার আয়োজন করে। সেখানে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। হামলায় পরিষদের অন্তত ১৫ সদস্য আহত হয়েছেন। পরে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে ছাত্রলীগের হাতে তাদের মারধর করা হয়। বিকেলে শাহবাগ থানার পুলিশ মেডিকেল সেন্টার থেকে পরিষদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে আটক করে।
পরদিন ছাত্রলীগের দুই নেতার নামে দুটি মামলা করেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। রাজু ভাস্কর্যের সামনে মাথায় আঘাত করে আহতের অভিযোগে মামলা করেছেন এক ব্যক্তি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ঘুষি মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছেন আরেকজন। গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীদের আদালতে তোলা হলে আদালত ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৪ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ছাত্রলীগের এই বেপরোয়া আচরণ বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে যে ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা কার্যকর, সেখানে এটাই হওয়া উচিত।
অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর এই মামলার প্রাথমিক রায়ে আবরারের পরিবার ও দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বস্তি এসেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মামলা পাওয়া, বিচার শুরু করা, বিচার শেষে রায় পাওয়া এবং সেই রায় কার্যকর করা বিশাল যুদ্ধ জয়ের মতো। যদিও এই পুরো প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত, তবুও কলামের আলোচনার খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যে, শীঘ্রই রায় কার্যকর হবে এবং ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সমাজে অপরাধের প্রবণতা কমাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যথেষ্ট নয়। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করা এবং তারা কেন অপরাধী হয়ে ওঠে তা বোঝার চেষ্টা করা এবং তা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। অন্যথায় শুধু শাস্তি দিয়ে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ দমন করা যাবে না।
আবরার হ’ত্যা’কা’রী’ কারা, তাদের পরিবার, তাদের লালন-পালন, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে দেশের বেশিরভাগ মিডিয়া বিশদভাবে প্রতিবেদন করেনি। তবে কিছু সংবাদপত্র এবং নিউজ পোর্টাল তাদের কিছু সম্পর্কে আমাদের কিছু তথ্য দিয়েছে। এই রবিনদের একজন সম্পর্কে কিছু তথ্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
রবিনের বাবা মাকসুদ আলী রাজশাহীর কাপাসিয়া গ্রামের ভরুয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং সে সময় আওয়ামী লীগের কাটাখালী শাখার ১নং ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জনাব মাকসুদ একটি নেতৃস্থানীয় নিউজপোর্টালকে বলেছেন যে তার ছেলের রাজনীতির সাথে সম্পর্ক খারাপ কিছু নয়। তিনি বলেন, আমি নিজেও রাজনীতি করি আমার ছেলেও। আমাদের মন্ত্রী ও বিধায়করাও অল্প বয়সে রাজনীতিতে আসেন। এভাবেই তারা হয়ে উঠেছেন আজকের রাজনীতিবিদ।
রবিনের এক বোনও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, মানুষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যোগ দেয়। ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই চাকরি পান না। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলে চাকরি পান।
দেশের এই অবস্থা একটা বিখ্যাত উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দুই ব্যক্তি হলেন আমেরিকার বিল গেটস এবং মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম। যুগান্তকারী কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিল গেটস ধনী হন। আর কার্লোস মূলত একজন টেলিকম ব্যবসায়ী। বিল গেটস ছিলেন একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান। তার মেধা, মেধা, দক্ষতা, চিন্তার উৎকর্ষতা এবং সর্বোপরি কঠোর পরিশ্রম তার আজকের অনেক ধনী হওয়ার পেছনে। অন্যদিকে কার্লোস স্লিম যখন খুশি তখনই তার সুবিধার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে মেক্সিকোর শাসক সরকারের সরাসরি ছত্রছায়ায় বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। যদি মেক্সিকান সরকার কার্লোস স্লিমকে সরাসরি সমর্থন না করত, তবে তিনি একটি শালীন ব্যবসা গড়ে তুলতে পারতেন না, যদি তাকে মোটামুটি স্বাস্থ্যকর, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মুখোমুখি হতে হয় তবে সুপার ধনী হওয়া যাক। মেক্সিকো সরকার ব্যক্তি কার্লোসকে এতটাই পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল যে শুধুমাত্র তাকে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মেক্সিকোর জাতীয় আয় ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৩ লাখ কোটি টাকারও বেশি কমেছে।
পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, সারা বিশ্বে এত ব্যবসায়ী থাকা অবস্থায় কেন এই দুজনকে আলাদা করে লালন-পালন করা হলো? এই কারণেই একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের বিপরীত পথে চলার দুটি ঘটনা ড্যারন এসেমাগ্লু এবং জেমস এ. রবিনসনের লেখা কেন নেশনস ফেইল: দ্য অরিজিনস অফ পাওয়ার, প্রসপ্রেরিটি অ্যান্ড পোভার্টি বইতে কেস স্টাডি হিসাবে উঠে এসেছে।
বইটিতে বিভিন্ন উপাত্ত-উদাহরণ সহ লেখক দেখিয়েছেন কখন, কেন এবং কীভাবে একটি দেশ সমৃদ্ধ, সমৃদ্ধ, জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণায় উন্নত হয় এবং কেন বা একটি দেশ জ্ঞান-বিজ্ঞান-আর্থিক-উন্নয়ন-সমৃদ্ধিতে পিছিয়ে থাকে। বইয়ের কেস স্টাডিতে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, আমেরিকায় জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা একটি শিশু তার শৈশব থেকেই শিখে যে সে যে পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, যদি তার প্রতিভা, ক্ষমতা, উদ্ভাবনশীলতা এবং সর্বোপরি কঠোর পরিশ্রমের মনোভাব থাকে, কিছুই তাকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধা দেবে না। বাধা দেওয়া যাবে না। যোগ্যতা দিয়ে তিনি হতে পারেন বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী-গবেষক, কিংবা সৎ ব্যবসা করে বিশ্বের সর্বোচ্চ বিলিয়নেয়ারদের একজন। তার সব যোগ্যতা কম হলেও সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। অতএব, জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে, তিনি প্রতিভা অনুশীলন এবং কঠোর পরিশ্রম করার চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে, মেক্সিকোর মতো দেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি শিশু তার রোল মডেল হিসেবে খুঁজে পায় একজন ধনী ব্যক্তি যিনি কার্লোস স্লিমের মতো সরকারের অন্যায় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকাশ লাভ করেছিলেন। শিশুটির মতে, সে যদি সমাজে সফল বা ধনী হতে চায় তাহলে তাকে সরকারের সাথে একটি অপবিত্র সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তার প্রতিভা, উদ্ভাবনী শক্তি বা কঠোর পরিশ্রম সে দেশে সমাদৃত হবে না। তাই বেড়ে ওঠা, অনেক মেক্সিকানদের জীবনের লক্ষ্য হল সরকারি সুবিধা পাওয়ার সেই চক্রে কীভাবে প্রবেশ করা যায়। যখন একটি জাতির বৃহৎ জনগোষ্ঠী তার মেধা, শ্রম ও উদ্ভাবনকে ত্যাগ করে সরকারের অংশীদারিত্বে পরিণত হয়, তখন দেশের অর্থনীতি এবং অন্যান্য সবকিছুই ধাপে ধাপে ভেঙে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা।
একদলীয় শাসনের অনেক দেশে, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, তবে অনেক দেশে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত না থাকলে এই সমাজে তার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি ‘নির্দলীয়’ লোকদেরও বর্তমান বাংলাদেশে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
রবিনের ভাবী যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, ‘মানুষ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে যোগ দেয়’, তখন তা নতুন কিছু শোনায় না। আমরা তখন বুঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার স্মরণে সমাবেশে ছাত্রলীগ কেন এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে নির্বাচনের প্রতিটি পর্যায়কে সামনে রেখে কেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভয়ানক সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন এ ঘটনাটি স্পষ্ট।
প্রসঙ্গত, তিন বছর পার হয়ে গেলেও এখনো এবারের ঘটনার সুরাহা হয়নি ঠিক মতো। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবার কথা থাকলেও তা এখনো করা হয়নি কার্যকর। আর এ নিয়ে এখনো তার পরিবারের মধ্যে বিরাজ করছে বেশ ক্ষোভ।