ক্ষমতার প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা যে পরিস্থিতি তৈরী করছে তাতে ছাত্র রাজনীতিতে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলচ্ছে বিভিন্ন মহলে। শুধু তাই নয় বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর যে ভাবে চড়া হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাতে অনেকেই ছাত্রী রাজনীতি বিমুখ হচ্ছে। এতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে তারাই যদি অপ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যায় তাহলে ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল।
আসিফ নজরুল লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি ও সাম্প্রতিক নানা সংকট নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
সংবাদমাধ্যম : ছাত্র রাজনীতি দেশে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
আসিফ নজরুল: খুবই সামান্য। কয়েকটি বাম দল এবং ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। ছাত্র রাজনীতির নামে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের সংগঠিত ও সহিংস আধিপত্য আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করত যদি তা বাম ছাত্র সংগঠন বা ছাত্র অধিকার পরিষদের না থাকত। ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের জীবনের অধিকার, বাঁচার অধিকার রক্ষায় কিছু ভূমিকা রাখছে।শিক্ষার অধিকার যদি বলেন, এটা এখন আর ছাত্ররাজনীতির ফোকাসে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের অত্যাচার, দুর্নীতি এবং অনাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর থেকে সাধারণ ছাত্রদের বেঁচে থাকাই এখন ছাত্ররাজনীতির মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে কিছু কিছু সংগঠন কিছু ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সেটাও পর্যাপ্তভাবে রাখতে পারছে না।
সংবাদমাধ্যম : দেশে বিদ্যমান শিক্ষার অবকাঠামো ও উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে ছাত্র রাজনীতির কি কোনো ভূমিকা আছে?
আসিফ নজরুল: উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে তো ছাত্ররাজনীতি সেভাবে ভূমিকা রাখে না। এর প্রধান দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। এখন শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকভাবে পড়ার পরিবেশ নেই। হলগুলির মধ্যে তাদের সাধারণ কক্ষে রাখা হয়, জোরপূর্বক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়, দাসত্বের জীবন বেছে নেওয়া হয়। তো এই দাসত্বের জীবন নিয়ে তারা বর্তমান যে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেটা বজায় রাখতেই তো হিমশিম খায়। ছাত্র পরিবহন, লাইব্রেরি সুবিধা, আবাসন ইত্যাদির অপ্রতুলতা রয়েছে। কিন্তু এখন শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে এগুলো আগের মতো বড় সমস্যা নয়। আপনি দেখেন কিছুদিন আগে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে শিক্ষা অধিকার সংক্রান্ত কিছু দাবি পেশ করার জন্য উপাচার্য মহোদয়ের কাছে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রকাশ্যে তাদের পেটানো হলো। স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি থেকেই তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের একটা ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার অধিকার তো দূরের কথা শিক্ষাঙ্গনে কোনো রকম মতভিন্নতা বা ভিন্নমত, সমালোচনা, তৎপরতা কোনো কিছুই তারা করতে দেবে না। তারা একটা অ্যাবস্যুলুট আধিপত্য বজায় রেখে সরকারি দলের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করবে। এর বিনিময়ে তারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করবে, সুযোগ-সুবিধা আদায় করবে আর স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে, নানা রকম পদ বিক্রি করার খবরও পত্র-পত্রিকায় দেখছি।
সংবাদমাধ্যম: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর প্রয়াসকে কীভাবে দেখছেন?
আসিফ নজরুল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডাররা বলছেন, এখানে ছাত্ররাজনীতি চান না। ইউজিসির নিয়মকানুন দেখলে দেখা যাবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ছাত্র সংগঠন বা তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। প্রথমেই আসা যাক ছাত্ররাজনীতির নামে যে অত্যাচার, পাশবিক নি/র্যাতন ও স/হিংসতা চলছে তাকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায় কি না। ওরা যেগুলো করে, সেসব তো ক্রিমিনাল অপরাধ। কিছু ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ। তো এই ফৌজদারি অপরাধ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আপনি অ্যালাউ করবেন কি না, এটাই প্রশ্ন। ছাত্ররাজনীতির নামে তারা এসব ফৌজদারি অপরাধের পরিধি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়।
সংবাদমাধ্যম : ইডেনে সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? এই ঘটনা কি নারীদের রাজনীতিতে আসতে বাধাগ্রস্ত করবে না?
আসিফ নজরুল : রাজনীতিতে আসা তো পরের কথা, কথা হচ্ছে যে অভিযোগটা উঠেছে জোর করে কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা এটা তো কমন, সবাই জানে; কিন্তু জোর করে তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা এটা সিরিয়াস অভিযোগ, এটা যদি দুই/চারজন মেয়ের সঙ্গেও হয়ে থাকে, সরকারের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া।
সংবাদমাধ্যম : যে লঙ্কায় যায় সে রাবণ। আমরা ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ উভয়ের আচরণ দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো কার্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি। তাদের নির্যাতনে সাধারণ ছাত্রদের মৃ/ত্যুও হয়েছে। মুক্তির উপায় কী?
আসিফ নজরুল: যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ এটা বর্তমান সরকারকে জাস্টিফাই করতে ব্যবহার করা হয়। দালালরা, বেতনভোগীরা এসব বলে। শোনেন, একটা সময় পর্যন্ত এটা প্রযোজ্য ছিল। একসময় ছাত্রদল অত্যাচার করত ছাত্রলীগের ওপর, আবার ছাত্রলীগ করত ছাত্রদলের ওপর এটুকু পর্যন্ত আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে গেছে, এখন তো সাধারণ ছাত্রদের, ছাত্রীদের ওপর অত্যাচার করে। বিশ^বিদ্যালয়ের হল প্রশাসনকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এটা আর একটা রাবণ পর্যায়ে নেই, তিনটা রাবণের সমান হয়ে গেছে। সে যদি পাঁচ বছরের জন্য থাকে সে আর কত বড় রাবণ হয়, কিন্তু সে যদি ১৫ বছর থাকে, তাহলে সেই রাবণের সাইজটা চিন্তা করেন। আগের যে কোনো সময়ের সঙ্গে এটা আর তুলনীয় না।
সংবাদমাধ্যম : ছাত্র রাজনীতির বর্তমান স্টাইল কি নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে?
আসিফ নজরুল: আমরা যে ছাত্র রাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করছি তা এখন আর ছাত্র রাজনীতি নয়। ছাত্ররাজনীতির নামে অত্যাচার, নিপীড়নমূলক আধিপত্য যেটা চলছে, এর প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ না থাকলেই তো ভালো। কিন্তু সুস্থধারার যে ছাত্ররাজনীতি আছে, বাম সংগঠনগুলো যেটা করে বা কোটা সংস্কার আন্দোলনে, সড়ক আন্দোলনে যেটা দেখেছেন… সেটার প্রতি তো তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের কমতি নেই। যেসব ব্যাপারে মানুষের অধিকার, জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সেখানে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে সাড়া দেয়।
সংবাদমাধ্যম :২৯ বছর পর সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল।তখন অন্য বড় বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আবারও সব বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র সংসদ কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না?
আসিফ নজরুল: ডাকসু নির্বাচনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো সরকারবিরোধী বা সরকারের সঙ্গে নেই এমন কিছু ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থানের কিছুটা জায়গা তৈরি হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন করার নিয়ম আছে, চাহিদা আছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রত্যাশা আছে, ইতিবাচক ফল আছে… এত কিছুর পরও না করার কোনো কারণ দেখছি না। একটাই যুক্তি হতে পারে সরকার চায় না। ডাকসু নির্বাচন হলে সরকার সমর্থক দলের একচেটিয়া আধিপত্য কিছুটা হলেও খর্ব হয়।
সংবাদমাধ্যম :সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। এই দুটি আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আসিফ নজরুল: সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, যারা তাদের জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে, দেশ নিয়ে চিন্তা করে, তারা সবই প্রতিফলন। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নির্মম দমনের ভয়াবহতা আমি ভুলতে পারি না। এই আন্দোলনের সম্ভাবনাকে সরকার বলপ্রয়োগ করে, গু/ন্ডা-পুলিশ ব্যবহার করে, বিভিন্ন মামলা দিয়ে দমন করেছে। ইস্যুটা কিন্তু দমন হয়নি, আন্দোলনটাকে দমন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সরকার দেশের ছাত্র রাজনীতিকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেটিতে কারর ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহ না থাকাটায় স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে এর ভবিষ্যৎ ভালো নয়।