বাংলা সিনেমার অন্যতম খ্যাতিমান ‘খল’ অভিনেতা মিশা সওদাগর। তবে শুরুতে নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি, কিন্তু পরবর্তীতে নিজেকে সফল ‘খলনায়ক’ হিসেবে গড়ে তুলে কোটি ভক্তের মনের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা অন্যতম গুণী এই অভিনেতা। আর এই মুহুর্তে এখনো প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করেন তিনি। আজকের জায়গায় আসার জন্য তুখোড় খল অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে। এ জন্য ছিল তাঁর আলাদা কৌশল। আজ তাঁর জন্মদিন। ক্যারিয়ারের নানা প্রসঙ্গে কথা বললেন এই অভিনেতা।
শুভ জন্মদিন…
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, এই ভালোবাসা কেমন লাগে?
জন্মদিন আমি সেই অর্থে পালন করি না। এবার ছেলে জোর করে কেক এনেছিল। তাকে দিয়ে কেক কাটিয়েছি। কিন্তু অনেকেই ফেসবুক, ফোনে শুভকামনা জানাচ্ছেন। অনেক আগের ছবি দিয়ে স্মৃতিকাতর করে তুলছেন। এসব ভালোবাসা সব পুরস্কারের চেয়ে বড়। শুটিং করতে গিয়ে আমার দুটি পায়ে আঘাত পেয়েছিলাম। যেকোনো সময় অপারেশন হয়তো করা লাগতে পারে। তিন মাস বসে থাকতে হতে পারে। এগুলো তাঁদের ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
শুটিং করতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন?
হ্যাঁ। কারণ, আমি কখনোই ডামি শুটিং করি না। নিজেই অংশ নেই।
শুরু থেকেই কেন মনে হলো ডামি ব্যবহার করবেন না?
এটা আমাকে টিকে থাকার জন্য করে যেতে হয়েছে। যখন আমি ভিলেন হিসেবে অভিনয় শুরু করি, তখন চারজন মহিরুহ ছিলেন। শ্রদ্ধেয় এ টি এম শামসুজ্জামান, খলিল সাহেব, হুমায়ূন ফরীদি, রাজীব সাহেব। তাঁদের সামনে দাঁড়াতে আমাকে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছে। অভিনয়ে তো তাঁদের ধারেকাছেও যেতে পারব না। তখন কৌশল হিসেবে নাচ, ফাইট এগুলোর দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়েছে।
শুটিং করতে গিয়ে আর কী ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন?
একবার ফাঁসির দৃশ্য করতে গিয়ে গলায় ফাঁস লেগে যায়। একদম আচমকাভাবে গলায় ফাঁস লেগে গেল। সেদিন মনে হয়েছিল, আমি আর বাঁচব না। পরে ফাঁসির দড়ি খুলে কীভাবে নামানো হয়েছিল, কিছুই মনে ছিল না। সেদিন মনে হয়েছিল, মারা যাচ্ছি। পরে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন আর ৩০ সেকেন্ড ফাঁস গলায় থাকলে বাঁচতাম না। এ ছাড়া ‘প্রাণের স্বামী’ সিনেমায় ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এটা এখনো ভোগাচ্ছে। আর কেটে যাওয়া, আঘাত পাওয়ার ঘটনা তো অহরহ।
নায়ক থেকে প্রতিষ্ঠিত খলনায়ক—কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
কাজকে আমি ভালোবাসি। দর্শকেরা আমাকে ভালোবাসেন। আমি চেয়েছি অভিনয় দিয়ে দর্শকদের ভালোবাসা আরও বেশি পেতে। এ জন্য আমি শুরু থেকে একটা অনুশীলনের মধ্যে রয়েছি। ব্যায়াম করি, নিজেকে ছোট হতে হয়, এমন কিছু করি না, চরিত্র ঠিক রেখেছি, কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না খারাপ ব্যবহার করেছি। আল্লাহর রহমত সবার আগে।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোন কথাগুলো মেনে চলেন?
আমার মা সব সময় বলতেন, ‘সৎ থাকবে, সত্য কথা বলবে। কখনোই গড্ডলিকায় গা ভাসাবে না।’ পরিশ্রম–সততা দিয়েই আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি টিকে থাকার।
অনেকের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, কারও উপদেশ মেনে চলেন?
রাজীব সাহেব বলেছিলেন, ‘ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করো তো আব্বু, এই কথা মেনে চলো, আমরা এমনিতেই খারাপ চরিত্রে অভিনয় করি। মানুষ ধরে নেয় আমরা ব্যক্তিজীবনেও খারাপ। শুটিংয়ের বাইরে সমাজের সাধারণ মানুষ যেন তোমাকে খারাপ মনে না করে। এ জন্য তোমাকে সব সময় সাদাসিধে পোশাক পরতে হবে, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে।’ রাজীব সাহেবের কথায় কানে দুল পরাসহ অতিরিক্ত ফ্যাশন ছেড়ে দিই। এ টি এম শামসুজ্জামান সাহেব বলেছিলেন, ‘তুই লুঙ্গি পরলে গ্রামের, কোট–টাই পরলে শহুরে। এমন লুকে তোর মতো এই প্রজন্মে আর কোনো ভিলেন নেই। তুই সফল হবি।’ জসিম ভাই বলতেন, ‘এমন ভিলেন হবি যেন তোর অভিনয়ে দর্শকদের চোখের পাতা না পড়ে।’ এ ছাড়া অনেকেই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সবার উপদেশ মেনে চলেছি।
ভিলেন চরিত্রে প্রাপ্তি কতটা, কখনো কি এই ভরসা সরে যাবে বলে মনে হয়?
৮০০–৯০০ সিনেমায় খল চরিত্র অভিনয় করেছি। পৃথিবীতে আমার মতো কেউ প্রধান ভিলেন চরিত্রে এত অভিনয় করেননি। পৃথিবীতে মান্না–শাকিব বাদে আমার মতো কেউ নাম ভূমিকায় এত ছবিতে অভিনয় করেননি। তার মানে আমাকে নিয়ে চরিত্র হয়েছে, হচ্ছে। ‘নুরা পাগলা’, ‘জ্যান্ত কবর’, ‘টপটেরর’সহ এমন অনেক সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছি। ‘কুস্তি’সহ এখনো একাধিক সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করছি। তিন যুগ আমার ওপর ভরসা পাচ্ছেন, ভবিষ্যতেও পাবেন। এ জন্য নির্মাতা–প্রযোজকদের কাছে কৃতজ্ঞ।
দীর্ঘ প্রায় তিন যুগে এফডিসিতে আপনার বিচরণ, ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালে কী মনে হয়?
এফডিসিকে একটি সারশূন্য ইন্ডাস্ট্রি মনে হয়। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরা একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছিলাম। সেই ধারাবাহিকতা আগের মতো তো নেই। একটি ব্যাখ্যা দিই, ছোটদের স্নেহ করা আর বড়দের সম্মান করা, এটাই এখন নেই। এখন তরুণদের মধ্যে অভিনয় যে নেশা, সে বিষয়ই নেই। অনেকেই এখন আগে বলেন, ‘কত টাকা দেবেন?’ আমাকে রাজীব ভাই, সোহেল রানা ভাই কাজের জন্য ডাকলে গিয়ে বলেছি, কোথায় স্বাক্ষর করব? টাকা নয়, কাজটাই বড় ছিল। সবার মধ্যে প্রফেশনালিজম আগের মতো নেই।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনের খবর কী?
আবার সভাপতি পদে নির্বাচন করব। নির্বাচন উপলক্ষে আজ এফডিসিতে একটি মিটিংয়ে যাচ্ছি। প্যানেল নিয়ে বিস্তারিত ৭ তারিখের মধ্যেই জানাতে পারব।
অভিনয় কর্মজীবনে প্রায় আট শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর। তবে পারিবারিক ভাবে তার নাম রাখা হয় শহীদ হাসান মিশা। অভিনয়ের ভূবনে পা রাখার পরপরই ভক্তের মাঝে ‘মিশা সওদাগর’ নামেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন তিনি। বর্তমানেও বেশ জনপ্রিতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন জনপ্রিয় এই অভিনেতা।