Thursday , November 14 2024
Breaking News
Home / Countrywide / সেচের বিদ্যুৎ সচিবালয়ের বিদ্যুতের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ: আসিফ নজরুল

সেচের বিদ্যুৎ সচিবালয়ের বিদ্যুতের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ: আসিফ নজরুল

সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে চলছে নির্ধারিত সময়ের জন্য লোডশেডিং, যেটার কারণে জনগণের মাঝে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে কলকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি কত দিন চলবে, সেটা এখনো জানা যায়নি। সরকার জ্বালানি তেলের সংকট লাঘবের জন্য এধরনের লোডশেডিং পরিচালনা করছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাব সরকারের প্রতি কেমন হবে সে বিষয়েও জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। এবার লোডশেডিংয়ের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন আসিফ নজরুল, যেটা হবুহু তুলে ধরা হলো-

কলম্বোর রাস্তায় গরুর গাড়ি চলছে। ফে”সবুকে এমন পোস্ট দেখে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর অতীত জৌলুশের কথা মনে পড়ে গেল। মানবাধিকার সংস্থার হয়ে কাজ করার জন্য আমি বহুবার সেখানে গিয়েছি। সমুদ্র তীরের সমান্তরালে চকচকে পাঁচতারা হোটেলের সারি, তার সামনে গলমুখী সড়কে বিদেশি পর্যটকের ভিড়, ভারত মহাসাগরের বুক থেকে উদ্ধার করা ভূমিতে নতুন জৌলুশের অবকাঠামো—এসব দেখে মনে হতো এই শহর হয়তো সত্যি সিঙ্গাপুরের মতো হয়ে উঠবে একদিন। ২০১৮ সালে শেষবারের মতো কলম্বো ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি আমার দেশের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম।

এখন জ্বালানি তেলের অভাবে চলছে গরুর গাড়ি। স্কুল-কলেজ বন্ধ, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য নিয়ে অভিযোগ, জনগণের ক্ষো”ভে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ক্ষমতাধর শাসক গোতাবায়া রাজাপাকসে। তার দুই ভাইও পলাতক রয়েছে। রাজাপাকসে পরিবারের প্রতি সহানুভূতির কিছু জায়গা এখনও আছে। তারা বে’পরো”য়াভাবে বিদেশী ঋণ নিয়েছে, দুর্নীতি ও মানবাধিকার ল”ঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তিনি জনগণের কর কমিয়েছেন এবং পরিবেশবান্ধব কৃষির পক্ষে রাসায়নিক সার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া রোগ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য এগুলি আ’ত্মঘা”তী হতে পারে বটে, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে দেখলে এসব তো খারাপ কিছু ছিল না

ভালো চিন্তার এমন ব্যর্থতাও আমাদের বর্তমান দুর্ভোগের পেছনে নেই। যা আছে সবই দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা। আমরা কোথায় সান্ত্বনা খুঁজব?

আমরা শ্রীলঙ্কা হইনি এখনও, হয়তো হবেও না। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা খুব বড় বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। ১২ বছর পর লোডশেডিংয়ের ঘোষণা, এক দশক পর আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন, ডলারের অভূতপূর্ব মূল্য বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, জ্বালানির ঘাটতি, সার কারখানা, সেচ ও পেট্রোল পাম্পে অনিশ্চয়তা—গত তিন মাসে এতগুলো ঘটনা এ বিপর্যয়েরই সাক্ষ্য বহন করে।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। জনগণকে যতটা সম্ভব খরচ কমাতে, জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে, অপচয় বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। দেশের সংকটে নাগরিকদের এসব করার চেষ্টা করতে হবে। যদি সরকার বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য আরও ব্যবস্থা নেয় (যেমন: সপ্তাহে দুই দিন অফিস-আদালত অনলাইন, ওই দুই দিনে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ, ব্যাটারি চালিত যানবাহনের উপর নিষেধাজ্ঞা, এসি ব্যবহারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, প্রিপেইড গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের ব্যবস্থা করা) তাহলে জনগণের উচিত এটি সমর্থন করা। কিন্তু এসব স্বতঃস্ফূর্ত করতে সরকারকে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, কিছু জবাবদিহিতাও করতে হবে।

সরকারকে প্রধান যে কাজটি করতে হবে তা হল নিজের খরচ কমানো। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাখ্যা করা যাক। বিতর্কিত ১০১৪ সালের নির্বাচনের পর, সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে পদোন্নতি দেয়, যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার সব সরকারি কর্মকর্তাকে স্বল্প সুদে গাড়ি কেনার অনুমতি দেয় এবং জ্বালানি ও চালকদের জন্য প্রতি মাসে ৪০,০০০ টাকা প্রদান করে। তখন সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রাইভেট কার কেনার উন্মাদনা ছিল এবং বিনামূল্যে পেট্রোলের ব্যবহারও ছিল ব্যাপক।

আমার প্রশ্ন হল, কেনাকাটা, যাতায়াত, স্কুলের ডিউটি ​​এবং বিনোদনের জন্য সরকারি কর্মকর্তার পরিবারের জন্য সাধারণ মানুষ কেন পেট্রোল এবং ড্রাইভারের খরচ বহন করবে? কোনো দেশে কি নেওয়া হয় এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত? সরকারের উচিত এই ধরনের মাসিক খরচ দেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করা। দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি ছাড়া সবাইকে সপ্তাহে অন্তত দুই দিন গণপরিবহন পুল বাস বা মাইক্রোবাস ব্যবহার করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা দেশের জনগণের সেবক মাত্র। অন্তত দেশের সংকটকালে এ কথা মাথায় রেখে তাদের বিলাসিতা কমানো উচিত।

লোডশেডিংয়ের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বৈষম্যহীনভাবে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের একটি বই পড়েছি। মেকিং অব এ নেশন বাংলাদেশ নামের বইটির একটি অংশ পড়ে জানা গেল, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রাজধানী থেকে আরও দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় কিছু ত্রাণ খাদ্য পাঠানোর সুযোগ ছিল। রাজধানীর মানুষ বিপর্যস্ত হলে সরকার আরও বিপাকে পড়বে এই চিন্তায় তা করা হয়নি। আমি মনে করি না আমরা এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি। সম্ভব হলে রাজধানীতে এক ঘণ্টা এবং গ্রামাঞ্চলে সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের তথ্য আমরা পেতাম না। মনে রাখতে হবে আমাদের খাদ্য ও কাঁচামাল আসে গ্রাম থেকে। সেচের বিদ্যুৎ সচিবালয়ের বিদ্যুতের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমি শুধু কিছু উদাহরণ দিলাম। বিভিন্ন মহল থেকে এ ধরনের আরও পদক্ষেপের প্রস্তাব আসছে। সরকারের উচিত এসব প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। কঠোরতার কথা বলে লোডশেডিংয়ের মতো কাজ করতে জনগণকে বাধ্য করা উচিত নয়। আপনি আচরি ধর্ম! আগে সরকারের লোকজনকে কৃচ্ছ্রের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।

লোডশেডিং, খরচ কমানো এবং দরিদ্র জনগণকে গ্রহণযোগ্য করতে সরকারকে কিছু বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। সরকার রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ ছাড়াই দিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মনে রাখতে হবে, এ টাকা সরকারের নয়, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন বিল বাড়িয়ে এই টাকা আমাদের পকেট থেকে নেওয়া হয়েছে। কুইক রেন্টালের নামে সরকার আমাদের এই লাখ লাখ কোটি টাকা কাকে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের কী সম্পর্ক তা জানার অধিকার জনগণের আছে। সঙ্কটের সময়ে বিদেশে অতিরিক্ত মুনাফা কর দেওয়ার অনেক নজির রয়েছে। দেশের এই সংকটকালে যারা রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তাদের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা উচিত। সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, সংসদ, উচ্চ আদালতের উচিত রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের নৈরাজ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা।

দেশের বিদ্যুৎ সংকটের পেছনে সরকারের আরও ব্যাপক ব্যর্থতা রয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট যে তারা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আসলে বিদ্যুৎ-নিরাপত্তা নয়, মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিশ্চিত করতে তাদের ব্যাপক গ্যাস অনুসন্ধান করা উচিত ছিল, বিকল্পভাবে তাদের বিদেশ থেকে এলএনজি কেনার জন্য দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করা উচিত ছিল। তা না করে কিছু মহলকে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা দিতে স্পট মার্কেট বা ফটকা বাজার থেকে এলএনজি কিনে আনা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন মধ্যকার সৃষ্ট সংকটের পর আমেরিকা ও ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে। ফলে বাংলাদেশকে এখন এলএনজির জন্য স্পট মার্কেটের ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। রিজার্ভ হ্রাসের এই সময়ে, এই আকাশচুম্বী ছাড়ের বাজার থেকে পর্যাপ্ত জ্বালানি কেনার সামর্থ্য নেই বাংলাদেশের।

কার স্বার্থে এবং কী উদ্দেশ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কেনার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। এই এলএনজি ব্যবসায়ীদের বেশি লাভের ওপর অতিরিক্ত কর দাবি করার অধিকার রয়েছে। যেকোনো সরকারি ব্যয়ের জবাবদিহি দাবি করার অধিকার।

মানুষ শান্ত থাকে, থাকতে চায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা তাদের ব্যথা এবং রাগ ভুলে যায়। শুধু আজকের শ্রীলঙ্কা নয়, সাম্প্রতিক অতীতে অনেক দেশেই আমরা দেখেছি, দেশের সংকটের সময় যখন এই ক্ষোভ ফেটে যায় তখন শান্ত সমুদ্র গর্জন করে।

জনগণকে শান্ত রাখা সরকারের দায়িত্ব। দেশের দুর্যোগের সময় যথাসময়ে সত্যিকারের জনবান্ধব পদক্ষেপ নিলে মানুষ শান্ত হবে। সরকার নিজেই কঠোরতা বজায় রেখে, কুইক রেন্টালের ওপর উচ্চ মুনাফা কর আরোপ, এলএনজি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, দেশের সম্পদ পাচা”রকারী, ব্যাংক ডাকাত ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, দরিদ্র মানুষদের বিভিন্ন সহায়তামূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণের অনেক দুর্ভোগ ও ক্ষো”ভ লাঘব করতে পারে।

প্রশ্ন হলো, সরকারের সদিচ্ছা আছে কি? সদিচ্ছা থাকলে তা বাস্তবায়ন করা কি সম্ভব?

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ খাত যেকোনো দেশের এমন একটি খাত যেটার কোনো বিকল্প নেই। একটি দেশের কৃষি থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্যর বিষয়টির উপর প্রভাব বিস্তার করে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া কোন কিছুই চলবে বর্তমান প্রযুক্তির সময় এটা ভাবা অনেকটা কষ্টসাধ্য। এই সরকারকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। সরকারকে এই বিষয়ে বড় ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

About bisso Jit

Check Also

উপদেষ্টা পরিষদেই বৈষম্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। ২৪ সদস্যের এই পরিষদে ১৩ জনই চট্টগ্রাম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *