বাংলাদশে গেলো কয়েকদিন যাবৎ একটি ঘটনা নিয়ে হয়েছে বেশ তোলপাড়।নিখোঁজের ২৯ দিন পর খুলনা নগরের দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা এলাকা থেকে মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। রহিমা বেগমের ‘অন্তর্ধন’ নিয়ে ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। তিনি নিখোঁজের শিকার হয়েছেন, নাকি অপহৃত হয়েছেন, নাকি আত্মগোপনে চলে গেছেন—এমন আশঙ্কাই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত হচ্ছিল।
এই হৃদয় বিদারক গল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল, যখন ২৭ দিন পর মেয়ে মরিয়ম মান্নান একজন মহিলার মৃতদেহকে তার মায়ের বলে শনাক্ত করেন। কিন্তু পরে দেখা গেল ওটা তার মায়ের ‘লা’শ’ নয়। এর পরপরই রহিমা বেগমকে ফরিদপুর থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর জানা যায়, এই এক মাসে রহিমা বেগমের নানা কর্মকাণ্ড। তার বিভিন্ন দাবির বিপরীতে কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয়, যার উত্তর তিনি নিজেই দিতে পারেননি বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে মানসিক ভারসাম্য হারানোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার ও তার মেয়ে মরিয়মের একের পর এক বক্তব্যে অসঙ্গতির কারণে বিষয়টি ঘোলাটে হয়ে গেছে।
শুরু থেকেই মেরে ফেলা হয়েছে বলা হলো কেন?
ঘটনা ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকায় বাড়ির আঙিনায় টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে যান রহিমা খাতুন। ঘণ্টাখানেক পরও বাড়ি না ফেরায় শিশুরা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এরপর নলকূপের পাশে মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র খুঁজে পাননি তারা। এরপর থেকে মরিয়ম মান্নান তার মাকে খুঁজতে থানায় যান, পুলিশ, মন্ত্রী, সাংবাদিক। মরিয়ম মান্নান তার মায়ের দেশে ফেরার আবেদন করেছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বারবার দাবি করেন যে তার মাকে হত্যা করা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সহযোগিতা না করার অভিযোগও করেন তিনি। মাকে হত্যার ভয় কেন সে প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
স্পটে না গিয়ে মায়ের লাশ পাওয়ার স্ট্যাটাস
২২ সেপ্টেম্বর, দুপুর ১২ :১৫ টার দিকে মরিয়ম মান্নান একটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমি এইমাত্র আমার মায়ের লাশ পেয়েছি।’ এরপরও তিনি ময়মনসিংহে পৌঁছাতে পারেননি। পচা ও অপরিচিত কাপড়ের ছবি দেখে এই লা’শ’ কিভাবে তার মায়ের বলে দাবি করলেন জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মেক চিনতে সন্তানরা ভুল করে না। কপাল, হাত, মুখ দেখে বুঝি এ শরীর আমার মায়ের। পরে রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের পর মরিয়ম বলেন, এটা স্বস্তির বিষয় যে এই ‘লা’শ আমার মায়ের নয়। আপনাদেরও তো খুশি থাকা উচিত।
প্রতিটি স্ট্যাটাসের বিপরীত পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে তিনি ভিন্ন ও নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হওয়ায় সমালোচিত হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, যা শুনেছি তাতে তথ্যের ঘাটতি আছে। তবে মরিয়মের অবস্থান পরিষ্কার মনে হয়নি। কথায় অনেক ধরনের অসঙ্গতি। বিশেষ করে সে যখন একটা মৃতদেহ না দেখেই বলতে থাকলো এটাই তার মা, তখন আরও খটকা লাগে।
জন্মনিবন্ধন আর লাশ পাওয়া একই দিনে
মরিয়ম যখন মায়ের লাশ পাওয়া গেছে দাবি করছেন ময়মনসিংহে, তার আগের দিন ২২ সেপ্টেম্বর মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম ফরিদপুরে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বোয়ালমারী উপজেলার চেয়ারম্যান আবদুল হক বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটার দিকে রহিমা বেগম তার কাছে আসেন। এ সময় রহিমা বেগম তাকে বলেন, তার জন্ম ও শৈশব কেটেছে সৈয়দপুর গ্রামে। তবে পরবর্তী সময়ে ঘটনাচক্রে দীর্ঘদিন তাকে বাগেরহাট গিয়ে থাকতে হয়। সেখানে তিনি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতেন। এখন আবার জন্মভিটায় ফিরে এসেছেন। এসে দেখেন ভাইয়েরা তাকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন। এ জন্য তার জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। একই সময়ে একদিকে শনাক্ত অযোগ্য লাশকে না দেখেই মায়ের লাশ মেনে নেওয়া এবং মা রহিমা বেগমের জন্মসনদের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৩২ বছরের শুনেও কেন মা বলে দাবি করলেন?
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার চিকিৎসক শোয়েব নাহিয়ান বলেন, ওই নারীর লাশটি অর্ধগলিত অবস্থায় ছিল। ওড়না পেঁচানো থাকায় গলায় দাগ ছিল। লা’শ’ অর্ধগ’লি’ত’ থাকায় ধ’র্ষ’ণের’ আলামত বোঝা যায়নি। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার বয়স আনুমানিক ৩০-৩২ হবে বলে আমরা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও বারবার মরিয়ম দাবি করেছেন এটি তার মায়ের ‘লা’শ।
মা ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরলেন না কেন?
রহিমা বেগমকে উদ্ধারের ১৪ ঘণ্টা পরে তার মুখ থেকে জানা যায়, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ মামলায় যাদের নাম রয়েছে তারাই মূলত অপহরণ করেছে বলে জবানবন্দি দেন তিনি। খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘রহিমা দাবি করেছেন অপহৃত হওয়ার কিছু দিন পর তার কাছ থেকে চারটি কাগজে স্ট্যাম্প নেন। এরপর এক হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে মুকসুদপুরের বাসে তুলে দেওয়া হয়। তিনি মুকসুদপুর গিয়ে পরিচিতদের কাছে কয়েক দিন কাটান। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সৈয়দপুরে কুদ্দুসের বাড়িতে ওঠেন। সেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন। যখন যেখানে ছিলেন তখন সেখান থেকে পরার কাপড় পেয়েছেন।
কেন ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন না সে বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর মেলেনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরো বিষয়টি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণকারী এক স্বজন বলছেন, অপহরণের ঘটনা সত্য হতে পারে। মুক্তি পাওয়ার পরে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্যও এমন কাজ করে থাকতে পারে।
রহিমা বেগমের পুত্রবধূ আর কল দিতে মানা করেছিলেন কেন?
বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামের যার বাড়িতে রহিমা বেগম আত্মগোপনে ছিলেন সেই কুদ্দুস বিশ্বাসের ভাগ্নে জয়নাল বলেন, মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেওয়া দুটি মোবাইল ফোন নম্বরেও (০১৭৭১১০..০২, ০১৫৫৮৩৪..০৫) যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। এর একটি নম্বরের কল রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের স্ত্রী রিসিভ করেন। জয়নাল বলেন, ‘রহিমার বিষয়টি তাকে বললে তিনি ওই নম্বরে আর ফোন দিতে নিষেধ করেন। এরপর ফোন দিলেও আর ফোন রিসিভ করেননি।’
তিনি কেন এমন করলেন, প্রশ্নে মরিয়ম বলেন, ‘এই এক মাসে পোস্টার দেখে অনেকেই কল করেছে। অনেকেই খবর দেওয়ার জন্য টাকা চায়। যে যখন যেখানে ডেকেছে, শুনে শুনে চলে গিয়ে দেখেছি খবর সত্য না।’
খুলনা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার মুসফিকুর রহমান বলেছেন, তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে এটা অপহরণের ঘটনা নাও হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তার সঙ্গে ব্যাগ ছিল, ওষুধ ছিল, আই-ড্রপ ছিল, কাপড় ছিল। একজন অপহরণ হলে তার কাছ এসব জিনিস থাকার কথা না। প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এটা অপহরণ নাও হতে পারে। তবে অধিকতর তদন্তের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মরিয়মকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কখনও কারও বিচার চাই, ফাঁসি চাই বলিনি। আমি বলেছি আমার মাকে চাই। আমি মাকে পেয়ে গেছি। আমার কোনও প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই।
প্রতিবেশীদের অভিযোগ
রহিমা বেগমের বাড়ির ভাড়াটিয়া মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রতিবেশী কারও সাথে রহিমা ও তার পরিবারের ভালো সম্পর্ক নেই। কথায় কথায় তারা লোকজনকে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন। অপর ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম বলেন, ‘রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। পুলিশ এসে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে দুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। রহিমাকে উদ্ধারের পর আমরা স্বস্তি পেয়েছি।’
রহিমা বেগমের নিখোঁজ মামলায় গ্রেফতার প্রতিবেশী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে খুলনা কারাগারে রয়েছেন। মহিউদ্দিন, তার ভাই গোলাম কিবরিয়া ও আরেক প্রতিবেশী নূরে আলম জুয়েল। গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী আয়েশা বলেন, এক মুহুরী প্রথমে রহিমা বেগমের সতীনের কাছ থেকে তাদের বাড়ির দুই কাঠা জমি কিনেছিলেন। ওই মুহুরী থেকে আমার স্বামী গোলাম কিবরিয়া ওই জমি কিনেছিলেন। এরপর থেকে রহিমা বেগম ও তার সন্তানরা আমাদেরকে মিথ্যা মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। তাদের সব হয়রানি প্রতিবেশী। মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি নূরে আলম জুয়েলের স্ত্রী সুমি বেগম বলেন, রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও আমার স্বামী কারাগারে রয়েছে। আমার এক এবং দুই বছরের বাচ্চা তাদের বাবার জন্য কাঁদছে।
প্রসঙ্গত, এ দিকে ওই নারী উদ্ধার হওয়ার পরে যেতে চাননি কোথাও ফিরে। বিশেষ করে তার যে মেয়ে এতো কিছু করেছে মাকে খুঁজে গিয়ে তার কাছে যেতেও সম্মত হননি তিনি। আর এই কারনে এই বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি খটকা লাগছে এখনো পুলিশের। জানা যাচ্ছে ৬ টি প্রশ্নের উত্তর পেলেই হয়টিও এই বিষয়টি নিয়ে হবে কোনো সুরাহা।