দেশে দ্রব্যমূল্যের দামের উর্ধ্বগতির বিষয়ে অনেকে উদাহরন টেনে বলছেন, দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, টাকাভর্তি ব্যাগ নিয়ে পকেটভর্তি বাজার করার মতন অবস্থা হতে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যখন পণ্যের মূল্যের থেকে টাকার মূল্য কম হয়ে যায়। যাকে আমরা অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বলি। বর্তমানে আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতি অকল্পনীয় বিপর্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতির তীব্র বৃদ্ধি অথবা্ হ্রাসের মত অভিজ্ঞতা হতে পারে রাষ্ট্রে। এমন অনেকগুলি কারণ রয়েছে। কারণ যাই হোক না কেন, তীব্র বৃদ্ধি অথবা হ্রাস এটা কোনো রাষ্ট্রের জন্যই ভালোকিছু বয়ে আনে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নে আমরা এতদিন গর্বিত, হঠাৎ করেই আঘা’ত পেয়েছি। দেশ যেমন মুদ্রাস্ফীতি দেখেছে, তেমনি মুদ্রাস্ফীতিও হয়েছে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম এতটাই বেড়েছে যে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য জীবন নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ( Bangladesh Bureau Statistics ) (বিবিএস ( BBS )) মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মেলে না।বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং ( South Asian Network Economic Modeling ) (সানেম ( Sanem )) বৃহস্পতিবার ( Thursday ) একটি ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেছে যে বিবিএস ( BBS ) জানুয়ারিতে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারিতে ৫.৮৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি জানিয়েছে, তারা ১১.৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি পেয়েছে। গ্রামীণ এলাকা শতাংশ. সানেম ( Sanem )ের মতে, শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৪৭ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় ১২.১০ শতাংশ।
অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির দিকে বাংলাদেশকে কড়া নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের মতে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া রোগের প্রাদূর্ভাবের পর দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্রই দ্রব্যমূল্য মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আ’গ্রাসনের পর পশ্চিমা অবরোধে বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীলতা। ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২১-২২ বাজেটে, বাংলাদেশ সরকার মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা করেছিল, তবে গত আগস্ট থেকে এটি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। তবে সরকার মহা’মা’রী মোকাবেলা করতে পেরেছে। সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করেছে আইএমএফ।প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারী সংকট শুরু হলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল। লকডা’উন চলাকালীন উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিপুল সংখ্যক লোক তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। এরপর সরকার ২৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে ১,৮৭,৬৭৯ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, যা দেশের জিডিপির ৬ শতাংশের সমতুল্য। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ খাতের দৈনন্দিন খরচ কমানো এবং দেশের অধিকাংশ মানুষকে দ্রুত টিকা দেওয়া জরুরি। আইএমএফের প্রতিবেদনেও এসব উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক অর্জনের উল্লেখযোগ্য দিক হল, প্রথমত, দেশের জিডিপির ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা। ২০১০ সাল থেকে তা ৫ শতাংশের উপরে। ফলে দারিদ্র্যের হার ধীরে ধীরে কমছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ। বাংলাদেশের এই সাফল্যের ফলস্বরূপ, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, এটি স্বল্পোন্নত দেশ কাতার থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পায়, IMF অনুসারে। গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের মুদ্রানীতি সফল হয়েছে। জিডিপির তুলনায় ঋণের হারও তুলনামূলকভাবে কম। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটা নির্ভর করে সরকারের প্রণোদনা তহবিল এবং কঠোরতা মুদ্রানীতির বাস্তবায়নের ওপর।২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩.২১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অনুমান করেছে। সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্ত বিশ্বব্যাংক মনে করে বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি পাবে না।
এগুলো সব শুভঙ্করের হিসাব। সব সরকার যা করে, বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিকরা তা করেছে। যে হারে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে মূল্যস্ফীতি যে হারে দেখানো হয়েছে তার থেকে একটু বেশি। এটা দেশের জন্য ভালো নয়।অতীতের একটি গল্প ১৯৫০-এর দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে অনাস্থা প্রস্তাবে হারিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারা দেশে খাদ্য ও সবজির দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা পাওয়া যায়নি। অবস্থা তখন প্রায় দুর্ভিক্ষের মতো। তখন আবু হুসেন সরকারের মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় ছিল। এই সরকারের খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে ঢাকা শহরেও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিশাল খাদ্য মিছিল বের হয়। অনাস্থা প্রস্তাবে এই সরকারের পতনের পর আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে। সে সময় আতাউর রহমানের সরকার ভুল করেছিল। চালের দাম কমাতে তিনি সব চাল সরকারি গুদামে খালাস করেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা চাল কিনে গোপনে মজুদ করে চালের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও সবজির দামও বেড়েছে। শুরু হয় সরকারের সমালোচনা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর হাসিনা সরকার দেশে আশ্চর্যজনকভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছে। ধান-চালের উৎপাদন এমনভাবে বেড়েছে যাতে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারে। ধারাবাহিক বন্যা-ঝড় ও মহা’/মারীর ফলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আর নেই। বাংলাদেশ আবার খাদ্য উৎপাদনে পিছিয়ে এবং খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী নিষ্ক্রিয় নন। তিনি বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানি করছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামের দিকেও নজর রাখেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সফল হয়নি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা বেশি চাপে রয়েছে। এই নির্বাচনী বছরে সরকারকে দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। তা না হলে জনগণের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। এ বিষয়ে সুযোগ পেলেই ইস্যু হিসেবে নেবে বিএনপি-জামায়াত। তারা ইতোমধ্যে দেশে খাদ্যমূল্যের জন্য আন্দো’লন করার চেষ্টা করছে।এটা এখন সাধারণ মানুষের ধারণা, দুর্ভিক্ষে ১০ জন প্রয়াত হলে সরকার তার হিসাব একজনকে দেয়। তারা খাবারের দামের সঠিক হিসাবও দেয় না। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সরকার ও দেশবাসীকে বিভ্রা’ন্ত করছে। দেশে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি ঘটেছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে বেড়েছে। খাদ্যমন্ত্রীর উচিত শুধু আমলাদের ওপর নির্ভর করা নয়, পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যক্তিগত সাহায্যও নেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগের কর্মীদের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করতে হবে। সরকারকেও দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে আ’ন্দোলন শুরু করতে হবে। করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য বিশ্ব খাদ্যের দাম তীব্রভাবে বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়। ইউরোপে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। ইউক্রেন থেকে এক মিলিয়ন শরণার্থী ইউরোপে এসেছে। কোথায় কিভাবে তাদের পুনর্বাসন করা যায় তা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো খুবই ব্যস্ত।আমি লন্ডনে বাস করি. এই লন্ডনেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব রয়েছে। দাম বাড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে। রাশিয়া রাশিয়ার সরকারকে আশ্বস্ত করেছে য চীন তেল ও গ্যাস কিনবে। ভবিষ্যতে এই বিপুল তেলের মজুদ নিয়ে চীন ভূ-রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সবাই চিন্তিত ও শ’/ঙ্কিত।
ইউক্রেনের যু”দ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে এবং সংকট তৈরি করবে। এই সংকট থেকে দেশকে বাঁচাতে পারে একমাত্র হাসিনা সরকার। দেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারাবে। এই সংকট মোকাবেলা করে হাসিনা সরকারকে জনগণের আস্থা বজায় রাখতে হবে। এটা শুধু নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নয়, জনগণের আস্থা ধরে রাখার জন্যও। আমার প্রত্যাশা যত বড় সংকটই হোক না কেন, সরকার জনগণের কাছে তা অস্বীকার করবে না এবং তাদের সহযোগিতায় সংকট উত্তরণে এগিয়ে যাবে। তারা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও সংকট কাটিয়ে উঠতে সফল হবে। এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযু”দ্ধে পরাজয়ের পর ভার্সাই চুক্তি জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য জার্মানির সাথে কোন আলোচনা করা হয়েছিল না। জার্মান অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তাদের উপর ক্ষতিপূরণের শর্ত আরোপ করেছিল। তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছিল। সেই পরিমাণ অর্থের যোগান দিতে জার্মানি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে৷ ফলাফল তৈরি হয় অধিক হারে হ্রাস মূল্যস্ফীতি। প্রায় কয়েকদিনে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হতে শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে চিকিৎসকরা, তাদের সম্মানী ভাতার পরিবর্তে ডিম বা অন্যান্য খাবার গ্রহণ করতে শুরু করেন। এই অবস্থায় হিটলার ক্ষমতা দখল করেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার পর মূল্যস্ফীতি হ্রাস কমতে শুরু করে।