Tuesday , September 17 2024
Breaking News
Home / Countrywide / সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যের কারসাজি, আত্মীয় ও বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের নিয়োগ বানিজ্য

সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যায়ের উপাচার্যের কারসাজি, আত্মীয় ও বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের নিয়োগ বানিজ্য

সদ্য প্রতিষ্ঠিত সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান রয়েছে, যেটা এখনও শেষ হয়নি। স্থায়ী ভবন বা অবকাঠামোগত কোনো কাজের এখনও অস্ত্বিত্ব নেই। শিক্ষার্থীদের পাঠদান এখনও আরম্ভ হয়নি। নগরীর চৌহাট্টা এলাকায় অবস্থিত সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চত্বরে অস্থায়ী কার্যালয় যেখানে রয়েছে সেখানো করা হচ্ছে সকল ধরনের অফিসের কাজ। এই ধরনের অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এর মধ্যে রয়েছে উপাচার্যের ১৩ আত্মীয় যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি পদে। ঐ পদে বেশিরভাগ নিয়োগ করা হয়েছে জামায়াত এবং শিবিরের লোক।

সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ৪র্থ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে তার কার্যক্রম আরম্ভ করে। ২০১৮ সালের ১৪ই নভেম্বর মোরশেদ আহমেদ চৌধুরী যিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নাইমুল হক চৌধুরী যিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) একজন কর্মকর্তা ছিলেন তাকে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বেশিরভাগই অস্থায়ী (অ্যাডহক) ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগে অর্থ লেনদেন ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়োগে যাতে কোনো ধরনের চাপ না আসে সেজন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা’হি/নীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালীদের আত্মীয়-স্বজনদেরও চাকরি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকের বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের স্বজনরাও চাকরি পেয়েছেন; যাদের অনেকেই ওই পদগুলোর জন্য যোগ্য নন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উপাচার্যের ১৩ আত্মীয়কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন শ্যালক নাহিদ গাজীর স্ত্রী ফাহিমা আক্তার মনিও। উপাচার্যের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় হিসেবে সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা) পদে নিয়োগ পেয়েছেন শাবিপ্রবির সাবেক শিবিরকর্মী সরোয়ার আহমদ।

উপাচার্য মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নঈমুল হক চৌধুরী দুজনেরই গ্রামের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জে। শাবিপ্রবিতে নঈমুল জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালে বিএনপি-জামায়াতপন্থী প্যানেল ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ ও ধ’/র্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী পরিষদ’ থেকে অফিসার্স সমিতির নির্বাচনও করেছেন। তিনি উপাচার্যের প্রশ্রয়ে নিজের মতাদর্শের লোকদেরও কৌশলে এখানে নিয়োগ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের ভাগ্নে রহমত আলী, মামাতো ভাই মোনাল চৌধুরীকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে ছাত্রশিবিরের সিলেট মহানগর শাখার সদস্য আলমগীর, দেলোয়ার ও ফারুকী এবং সদর উপজেলা শিবিরের সাবেক নেতা সাফওয়ান আহমদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপসহকারী প্রকৌশলী পদে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) শিবিরের সাথি আশরাফ হোসেন এবং সেকশন অফিসার হিসেবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকর্মী বেলাল উদ্দিন নিয়োগ পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হ’/’ত্যাচে’ষ্টা মা’মলার আ’/সা’মি হারিছ চৌধুরীর আত্মীয় বেলাল চৌধুরীসহ বিএনপি-জামায়াতের মোট ১৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নঈমুল হক চৌধুরী জামা’য়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি না, এ বিষয়টি তাঁর জানা নেই মন্তব্য করে উপাচার্য একটি জনপ্রিয় দৈনিককে বলেন, ‘তা ছাড়া তিনি ঠিক রেজিস্ট্রারও নন, ফিন্যান্স ডিরেক্টর।’ নিজ দলের লোকজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে সুবিধা দিচ্ছেন নঈমুল—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিপুলসংখ্যক লোকবল নিয়োগে লেনদেন ও অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। তা ছাড়া যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এর বেশির ভাগ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। কর্মকর্তার সংখ্যা খুব বেশি নয়।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান শুরুর আগে এত জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দাপ্তরিক কাজ, সাইড দেখাশোনাসহ নানা কাজের জন্য তো লোক লাগে।’ নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অ্যাডহকে লোকজন নেওয়া হলেও নিয়ম মেনে অনেকের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে। বাকিদেরও হবে।’ সিন্ডিকেটে বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে বলেন, ‘স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া শুরুর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। পরে প্রক্রিয়া মেনেই স্থায়ী করা হবে।’

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কৌশল

অনুসন্ধানে জানা যায়, উৎকাচের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে কৌশল নেন উপাচার্য ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদের বিপরীতে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের সুবিধা করে দিতে গত ১০ জানুয়ারি ছয়জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে একই কৌশল নেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কলামে লেখা ছিল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহাট্টাস্থ অস্থায়ী ক্যাম্পাসে সরাসরি নিজে/প্রতিনিধির মাধ্যমে যোগাযোগ করে যোগ্যতাসংবলিত তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।’ চলতি বছর আরো তিনটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও এভাবে নানা কৌশল নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫ জুলাই প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে একজন করে সহকারী রেজিস্ট্রার ও সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে সর্বনিম্ন বয়স ৩৭ বছর উল্লেখ করা হয়। পছন্দের প্রার্থীকে সুবিধা দিতে এই বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একই বিজ্ঞপ্তিতে একজন করে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী প্রকৌশলী পদের জন্য বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ৩০ বছর ছিল। ২৬ জুলাই বিজ্ঞপ্তিতে উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদের সর্বনিম্ন বয়স ৪২ বছর উল্লেখ করা হয়। এ অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘সিন্ডিকেটের অনুমোদন নিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছামতো কিছু করা হয়নি।’

প্রশ্নপত্র ফাঁ’সের অভিযোগ

গত ২২ অক্টোবর সিলেট নগরের পার্কভিউ হাসপাতালে সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগে পছন্দের প্রার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠে কর্তৃপক্ষের বিরু’দ্ধে। স্থায়ী নিয়োগের এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সেকশন অফিসার পদে আটজন এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ৯ জন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই পেয়ে যান। এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ কেউ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।’

নিয়োগ পাওয়া অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ

নিয়োগ পাওয়া অনেকের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা আব্দুস সবুরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অ্যাডহক ভিত্তিতে এ ধরনের নিয়োগ অবৈধ বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে। আব্দুস সবুর ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে উপাচার্যের আরো ১২ আত্মীয় নিয়োগ পেয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া একজনের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ১.৬০, যা তৃতীয় শ্রেণির সমমর্যাদার। নিয়োগবিধি অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া কাউকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো অনেকের নিয়োগের ক্ষেত্রেও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যতা শিথিল করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনেককে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের যোগ্যতা উল্লেখের নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম েখনও শুরু হয়নি তার আগেই বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োগের ঘটনা ঘটিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যার জন্য অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সিলেটের শাবিপ্রবিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার সংখ্যা ২৬৪ জন। অন্যদিকে সিকৃবিতে প্রায় ৩০০০ শিক্ষার্থী রয়েছে কিন্তু এত কম শিক্ষার্থীদের জন্য ১৪৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাঠদান ও অন্যান্য কার্যক্রম আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই ১৭৮ জনকে নিয়োগ প্রদান করেছে কর্তৃপক্ষ।

সিলেটে তদন্ত কমিটি

যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য সোমবার ও মঙ্গলবার অভিযোগের বিষয়ে খ’তিয়ে দেখেছে ঢাকা থেকে আসা তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল যারা গত রবিবার সিলেটে এসেছে। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন যিনি অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নিরীক্ষা বিভাগ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সোমবার ও মঙ্গলবার নাইমুল হক চৌধুরী যিনি সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তিনি কল রি’সিভ করেননি।

উল্লেখ্য, হাবিবুর রহমান যিনি সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন তার প্রস্তাব অনুযায়ী সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার মাধ্যমে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামকরন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে। গেল ২৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যেটার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

About

Check Also

হাসিনার ভাগ্য নির্ধারণের আর পাঁচ দিন, বিপাকে ভারত

আগামী ২০ সেপ্টেম্বর শেষ হতে চলেছে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিসার মেয়াদ। বর্তমানে, কূটনৈতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *