ইজাজ উদ্দিন আশিক (২৬) পেশায় আইনজীবী। রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের চতুর্থ তলার একটি রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ছাদে উঠে রক্ষা পান এই যুবক। দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি সেই রাতের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এত মানুষের মৃ/ত্যু বৃথা যেতে পারে না। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবছেন তিনি।
ইজাজ উদ্দিন আশিক বলেন, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ২০ মিনিটে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের চতুর্থ তলায় খানাস রেস্টুরেন্টে যাই। সেখানে এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন। খাবার অর্ডার করার পর কথা বলছিলাম। হঠাৎ চিৎকার শুরু হয়ে গেল। রেস্তোরাঁ থেকে বলা হচ্ছে, নিচে আ/গুন লেগেছে, সবাই সতর্ক রয়েছে।
এ সময় সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমি আমার ক্লায়েন্টের সাথে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও করি। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলাম যখন আমি আমার নীচের মেঝেতে একটি বি/স্ফোরণ শুনতে পেলাম। ফলে আমি ছাদের দিকে উঠতে লাগলাম। ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি রয়েছে। কোন জরুরী কোনো সিঁড়ি নেই। ছাদে উঠতেই দেখলাম উপর থেকে লোকজন চিৎকার করছে।
বিষাক্ত ধোঁয়ায় আরও বেশি মানুষের মৃ/ত্যু হয়েছে উল্লেখ করে আশিক বলেন, “মানুষ পাগলের মতো বের হওয়ার চেষ্টা করছিল। আমিও মানুষের চাপে নিচে নামতে শুরু করি। তখন নাকে বিষাক্ত কিছুর গন্ধ টের পাই। মনে হয় যে গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে, ধোঁয়া আছে। এদিকে বিদ্যুৎও চলে গেছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় আমার সামনের লোকজন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে আমি আমার মক্কেল ও আশেপাশের লোকজনকে নিয়ে আবার ছাদের দিকে গেলাম। কিন্তু সিঁড়িগুলো খুবই ছোট, মানুষের চাপ বেশি। বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না। এক পর্যায়ে ধোঁয়া কমাতে নাকে ব্লেজার চেপে ধরলাম।’
ছাদে গিয়েও দেখলাম আগুন খুব কাছে। বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, এর পর কোনোমতে পড়ে থাকা লোকজনের ওপর দিয়ে দৌড়ে একপর্যায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ছাদে পৌঁছে যাই। আমি ছাদে পৌঁছানোর শেষ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ছাদেও আ/গুন আমাদের থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ছড়িয়ে পড়ে। সিঁড়ির লোহার রেলিং আগুনের তাপে গলে যাচ্ছিল। তখন আমি সত্যিই বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে ফেলি। তাদের মধ্যে দুইজন ছাদের থেকে লাফিয়ে পড়ে। আমি তাদের অনেক কিছু বলেছি, কিন্তু আমি তাদের সম্পর্কে শুনিনি।
ছাদে রেস্টুরেন্ট ছাড়াও স্টাফদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। যাতে আ/গুন দ্রুত সেখানে না পৌঁছায়, আমরা ঘরের তোষক-বালিশসহ অন্যান্য জিনিসগুলি ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিই যাতে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। তারপর আমিও লাফ দেবার কথা ভাবলাম, কিন্তু সাহস পেলাম না। এরই মধ্যে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেছি।সিদ্ধান্ত নেই মরতেই যখন হবে, সিজদায় পড়ে যাই। অতঃপর ঐ ঘরে থাকা জায়নামাজ নিয়ে আসি। এ সময় পাশের ভবন থেকে ফায়ার সার্ভিস সিঁড়িতে আ/গুন নেভাতে শুরু করে।
তখন মনে হলো আল্লাহ রক্ষা করবেন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা শেষ পর্যন্ত ছাদ এবং সিঁড়ির আগু/ন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় এবং আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। এরপর তারা ছাদে অবস্থান নেয় এবং প্রথমে নারী ও শিশুদের এবং পরে আমাদের উদ্ধার করে,” যোগ করেন আশিক।
এই তরুণ আইনজীবীর মতে, আ/গুনে মৃতের সংখ্যা আসলে আরও বেশি হতে পারে। তাদের বেশিরভাগই বিষাক্ত ধোঁয়ায় মা/রা গেছে। তিনি বলেন, “আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম, তখন আটকে পড়া মানুষের চিৎকার, শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভু/লার মতো না। ঘটনার পর যখনই আমি একা থাকি, তখনই আমার এগুলো কানে বাজে এবং চোখে ভাসে। সে কারণেই যখন আমি ছিলাম উদ্ধারের পর হাসপাতালে নিয়ে যাই, পরের দিন সকালে চলে আসি। কারণ হাসপাতালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি এখনও ট্রমার ভিতরে আছি।’
আশিকের দৃষ্টিতে এটি কোনো দু/র্ঘটনা নয়, কিছু মানুষের অনৈতিক লালসায় ঘটে যাওয়া হ/ত্যাকাণ্ড। এজন্য তিনি নিজে থেকেই আইনি ব্যবস্থা নিতে চান। তিনি বলেন, এত মানুষের জীবন বৃথা যেতে পারে না।